আর কত আছিয়ার প্রাণ ঝরবে!

শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;

জামালপুরের স্কুলছাত্রী আশা মনি ২০২২ এর এমন দিনে যৌন নির্যাতনের স্বাীকার হয়ে বাবা মাকে চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করে। বিচার আর চায়নি সে সমাজের কাছে। আজ চলে গেলো ছোট মেয়েটি। তখনও মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো। যুগ যুগ ধরে চলছে এ নির্যাতন। আসামীরা ধরা পড়ে আবার জামিনে বেরিয়েও যায়।

ফুলের মতো নিষ্পাপ আছিয়া চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণ করে ঝরে গেলো। আছিয়া নামটি এখন দেশ এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে দূর দূবান্তে চলে গেছে। মেয়েটির বয়স মাত্র আট। মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মা। মেয়েটি এখন আর নেই, সে এখন পেরিয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবীর আলো। বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেছে। আছিয়াকে ধর্ষণের খবরে সারা দেশে তৈরি হয় ক্ষোভ। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি চলছে।

আছিয়ার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত তিনটি শিশুর ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। মানিকগঞ্জে ৩ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশুটি সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জে ৬ বছরের শিশু, পঞ্চগড়ে ৩ বছরের শিশুকে ধর্ষনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আছিয়ার জন্য যে আন্দোলনের ঝড় উঠেছে তা যেন আর কোন শিশুর জন্য না করতে হয়। অপরাধীকে যেন সর্বোচ্চ সাস্তি নিশ্চিত করা হয়। তারা মনে করেন, আছিয়ার মাধ্যমেই সব শিশু নিরাপত্তা ফিরে পাক। আর কোন আছিয়াকে যেন অঙ্কুরেই ঝরে যেতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তারা বলছেন, নানা অজুহাতে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নারীকে হেনস্তা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। দ্রুত বিচার করে ধর্ষককে জনসম্মুখে শাস্তি দেয়া গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা গুরুতর হয়, সেসব উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে। এর বাইরে অনেক খবর আড়ালেই থেকে যায়। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বিষয়ে ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছর নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৭ মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮৬১টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণ, ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ছয়জন। অধিকারকর্মী শাশ্বতী বিপ্লব বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি সবসময়ই বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘খুবই খারাপ’ অবস্থা এবং কোনো ধরনের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে আসলে প্রচুর পেডোফাইল(শিশুকামী) আছে। তিনি মনে করেন, আছিয়ার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন। দেশে আইন প্রতিষ্ঠিত হলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হবে।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আট জনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হবার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা অধিকার কর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

শিশু ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে শিশুটির মা অভিযোগ করেন, মেয়ের স্বামীর সহায়তায় তাঁর বাবা (শ্বশুর) শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি মেয়ের শাশুড়ি ও ভাশুর জানতেন। তাঁরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যাচেষ্টা চালান। এই মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

শিশু আছিয়ার মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনাগুলোর দ্রুত উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করার জন্য আগামী রোববার থেকে সোমবারের মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীনে শুধু মাত্র শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনাগুলোর দ্রুত উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে যাচ্ছি। এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিধান থাকবে। এর কাজ হবে শুধুমাত্র শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনার বিচার দ্রুত করা। এতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকবে। তিনি আরো বলেন, ধর্ষণ ব্যক্তিপর্যায়ের অপরাধের ঘটনা। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, এখানে আমাদের বিন্দুমাত্র অবহেলা নেই। আপনারা দেখেছেন, এ ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরের দিনই ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে।

সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সভাপতি প্রফেসর ড. শামীমা তাসনীম বলেন, যুগ যুগ ধরে আমরা দেখে এসেছি এ ধরনের ধর্ষণে আলামত নষ্ট করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রেয়ে গেছে। অনেক সময় থানায় কেসও নেয়া হয়নি। যদিও বা কোনো ধর্ষককে আইনের আওতায় আনা গেছে বা নাম গণমাধ্যমে এসেছে, দেখা গেছে, তিনি কোনো না কোনো এমপির আত্মীয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক অস্থিরতার সময় নারী ও শিশুর প্রতি যৌনÑসন্ত্রাস বাড়ে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। ৫ আগস্টের পর অনেক কয়েদি পালিয়েছেন। এখন নারীবিদ্বেষী প্রচারও বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি তো এ দেশে রয়েছেই। এ সুযোগগুলো নিচ্ছে অপরাধীরা। শুধু নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।