বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স। ঝুকিমুক্ত নয় বাংলাদেশও। মহামারি করোনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শনাক্ত হতে শুরু করেছে নতুন আতঙ্ক মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স ভাইরাস। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে এরই মধ্যে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এ ভাইরাস নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে।
মাঙ্কিপক্স নামে এ ভাইরাসটি পূর্বেও পরিচিত ছিল। এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায়। এ ছাড়াও সঙ্গম, ত্বকের সংস্পর্শ, কথা বলা বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে।
এমপক্স (মাঙ্কিপক্স) ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, কেনিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। পাকিস্তানের শনাক্ত হয়েছে এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তি। (ডব্লিউএইচও) বিশ্বব্যাপী এমপক্স বিস্তারের ব্যাপারে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। এ অবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশে হটলাইন চালু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কারো মধ্যে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে সন্দেহভাজনদের ১৬২৬৩ এবং ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া এমপক্স প্রতিরোধে দেশের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত বিমানবন্দর এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
ঝুঁকিতে বাংলাাদেশ: এমপক্স নিয়ে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে আছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পুরো বিশ^ই এখন কাছাকাছি চলে এসেছে। বিশে^র কোন প্রান্তে কোন রোগ হলে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়। সে হিসাবে বাংলাদেশও ঝুঁকি রয়েছে। আফ্রিকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুব বেশি নেই। তবে বাংলাদেশের কিছু মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরিসূত্রে আফ্রিকায় থাকেন। যাতায়াত করেন। অল্প হলেও যাতায়াত আছে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এমপক্স আসতে পারে। এছাড়া এফ্রিকার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর যোগাযোগ ভালো। সেখানে আমাদের দেশের অনেক লোক আছে। সুতরাং ঝুঁকি নেই তা বলা যাবে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ ঝুঁকিটা রয়েছে।
এদিকে ডব্লিউএইচওর সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, মাঙ্কিপক্স একপ্রকার সংক্রামক রোগ। এর উপসর্গ অনেকটা জ্বর বা ফ্লু’র মতো। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাস থেকেও অন্য কেউ এতে সংক্রমিত হতে পারে।
এমপক্সের লক্ষণ : রোগটির বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। প্রথম পর্যায়ে রোগীর জ্বর আসে, পাশাপশি শরীরে দেখা দেয় ফোসকা ও অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলা।
গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। এতে বেদনাদায়ক ফুসকুড়ি, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া এবং জ্বর হতে পারে। মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, কেনিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। আপনার শরীরে এর কোনো লক্ষ্মণ দেখা দিলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে, অথবা সংক্রমিত দেশ ভ্রমণের ২১ দিনের মধ্যে এই লক্ষ্মণ দেখা দিলে ১৬২৬৩, ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করুন।
বেবিচকের বিজ্ঞপ্তিতে, এয়ারলাইনসগুলিকে সতর্ক থাকতে এবং কোনো লক্ষণযুক্ত যাত্রী থাকলে দ্রুত স্বাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করতে বলা হয়। আগমনের ২১ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলি দেখা দিলে যাত্রীদের ১০৬৫৫ নম্বরে কল করতেও অনুরোধ করা হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। লিফলেট বিতরণ করছে এবং আগমন স্বাস্থ্য ডেস্কগুলো ২৪/৭ ডাক্তার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আগত যাত্রীদের তাপমাত্রা থার্মাল স্ক্যানার আর্চওয়ে দ্বারা স্ক্রীন করছে। প্রয়োজন হলে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পাঠানো হবে বলেও জানানো হয়।
কেনো বাড়ছে সংক্রমণ?
ক্লেড-১ এবং ক্লেড-২ হলো এমপক্সের দুটি প্রধান ধরন। ক্লেড ১ আবার দুই রকমের- ক্লেড ১-এ এবং ক্লেড ১-বি। ক্লেড ১-বি ভেরিয়েন্ট এর দেখা মিলেছে কঙ্গোয়। এ ছাড়াও কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও উগান্ডায়ও এটি দেখা গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সংক্রমণ বাড়াচ্ছে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি। সাধারণত আগে সংক্রমিত বুশমিট খেয়ে ছড়াতো ক্লেড ১। কিন্তু এখন মানুষের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে ক্লেড ১-বি , যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে বিশেষ করে ছড়াচ্ছে এটি। এ ছাড়াও বিছানা বা তোয়ালের মাধ্যমে কিংবা শারীরিক ছোয়ায়ও ছড়াতে পারে এটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমপক্স প্রধান ড. রোসামুন্ড লুইস বলেছেন, এটি বেশি সংক্রামক কি না তা অজানা হলেও, এটি সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্লেড ১-এ ভেরিয়েন্ট ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও পাওয়া গেছে। ডব্লিওএইচও আরও জানিয়েছে, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও ক্লেড-২ পাওয়া গেছে।
ঝুঁকিতে বেশি শিশুরা
শিশুদের মধ্যে এমপক্স ভাইরাসটি বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। এ ছাড়া, শিশুরা বেশি শারীরিক সংস্পর্শে আসে এবং নিজেরা অনেক সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে তারা বেশি সংক্রমিত হতে পারে।
সংক্রমিত মানুষের মাধ্যমে ভাইরাসটি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। দূরপাল্লার একজন ট্রাকচালকের মধ্যে এমপক্স শনাক্ত করেছেন কেনিয়ার কর্মকর্তারা। যিনি তানজানিয়া, রুয়ান্ডা এবং উগান্ডায়ও ছিলেন। এ ছাড়া ভাইরাসটি যৌনসম্পর্কের মাধ্যমেও অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। যৌনকর্মীরা শুরুর দিকে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল।
২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে এমপক্স ছড়িয়ে পড়ায় সমকামী এবং উভয়কামী পুরুষরা প্রধানত আক্রান্ত হয়েছিল। তবে কঙ্গোতে ১৫ বছরের নিচে ৭০ শতাংশ শিশু ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে মৃত্যু ঘটছে ৮৫ শতাংশের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় এবং পুষ্টির অভাব থাকায় তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। গুটিবসন্তের টিকা নেওয়ায় বয়স্করা কিছু সুরক্ষা পেতে পারেন। সেভ দ্য চিলড্রেনের কঙ্গো পরিচালক গ্রেগ রাম উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা শিশুরা বেশি শঙ্কায় আছে— যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অন্তত তিন লাখ ৪৫ হাজার শিশু বসবাস করছে।
প্রতিষেধক কি আছে?
এই রোগের ভ্যাক্সিন বা টিকা আছে, তবে মূল সমস্যা এটি সরবরাহ করতে পারায়। আফ্রিকার সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সংস্থা মাত্র দুই লাখ ডোজের সরবরাহ পেয়েছে। যেখানে প্রয়োজন ছিল ১০ মিলিয়ন ডোজের। পরীক্ষার এবং চিকিৎসা অভাবেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
এখনো পর্যালোচনাধীন আছে টিকাদানের পরিকল্পনা। তবে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা রোগী এবং এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের মতো ঝুঁকিপূর্ণদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এ পর্যন্ত দুটি টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর আগে বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে ভাইরাসটি ইউরোপ থেকে ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে ডব্লিউএইচও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সেইসাথে ব্যাপক টিকাদান ও সুরক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০২৩ সালের মে মাসে তুলে নেওয়া হয় জরুরি অবস্থা।