টালমাটাল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব

চলতি বছরে পুঁজিবাজারে ক্ষত আরো গভীর হয়েছে। কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারেনি পুঁজিবাজার। বছড়জুড়ে সূচক, মূলধন ও পুঁজি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। ছিল কারসাজি চক্রের অশুভ তৎপরতা। বছরের প্রথমার্ধে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করলে দর সংশোধনের ফলে পতন দেখা দেয় পুঁজিবাজারে। বছরের শেষার্ধে সরকার পরিবর্তনের পর সংস্কারের উদ্দেশ্য নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এতে ফের অনাস্থা ও দরপতনে আতঙ্ক কাটেনি পুঁজিবাজারে। এসবের মধ্যে পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তি বা আইপিও বাজারও ভালো ছিল না। এমনকি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লভ্যাংশ ঘোষণায় ব্যর্থ ছিল। একইসঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট এবং দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতায় পুঁজিবাজারকে তলানিতে নিয়ে গেছে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

জুলাই বিপ্লবে সরকার পরিবর্তনে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আসে পালাবদল। সব খাতে শীর্ষ নেত্বত্বের পালা বদলে পালিয়ে যান শিবলী কমিশন। দায়িত্ব নেন মাসুদ কমিশন। তবে এই সময়ে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি) কঠোর অবস্থান নিলেও তা কাজে আসেনি। পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা না ফেরায় বছরজুড়েই ছিল বিক্ষোভ কর্মসূচি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারের পতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের ‘লং মার্চ‘ কর্মসূচিতে বিএসইসির কার্যালয় ঘেরাও এবং প্রধান ফটকে তালা দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নতুন কমিশন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে তা দৃশ্যমান নয়। বিনিয়োগকারীরা নতুন বছরে ভালো কিছু দেখার প্রত্যাশা করছেন। অপরদিকে, বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি বছরে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি পতন ঘটেছে।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের অনেক দোষ আছে। তিনি আরো বলেন, আপনারা জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনছেন, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ন্যূনতম কোনো মূল্য নেই, এগুলো কয়েক দিন পরই ওয়েস্ট পেপার হিসেবে ব্যবহার হবে। এজন্য একটু কষ্ট করতে হবে। আমি বিনিয়োগকারীদের দায়ী করছি না। পুঁজিবাজারের প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের অনেক দোষ আছে।

সমালোচিত ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার :
পুঁজিবাজারের দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। এতে একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে পুঁজিবাজারে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি প্রথম দফায় ৩৫টি বাদে বাকি সব প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় পুঁজিবাজার থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়। ফ্লোর প্রত্যাহারের পরই দরপতন শুরু হয়। এতে পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক দরপতনের কারণে মার্চ শেষে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বাজার মূলধন কমে গেছে।

নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ পদে রদবদল:
চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। সে হিসেবে তিনি চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে দায়িত্ব দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ১৯ আগস্ট তিনি বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। সে হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ চলতি বছরে বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে প্রায় সাড়ে ৪ মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনি ১৫টি সভা করেছেন, যার প্রায় সবকটিতে কারসাজিকারীদের নাম প্রকাশ্যে এসেছে।

সর্বোচ্চ জরিমানা :
নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২২ কোটি টাকার জরিমানা করা হয়েছে, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে কোনো একটি বছরের সর্বোচ্চ। যুগের পর যুগ ধরে পুঁজিবাজারের আলোচিত চরিত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান এবং সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরুর নাম।
এ ছাড়াও নতুন আলোচনায় আসা ব্যক্তিদের মধ্যে পুঁজিবাজারে লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেইস ম্যানেজমেন্টের অংশীদার চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, আরেক অংশীদার হাসান তাহের ইমাম, এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম। এছাড়া বছরের শীর্ষ আলোচনায় ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলা মতিউর রহমান। ঘুষ এবং শেয়ার ব্যবসা করে অঢেল টাকা আয় করেন তিনি। কিন্তু কোরবানীর ঈদে কেনা ছাগল কাণ্ডে তিনি ব্যাপক আলোচিত হন। এক পর্যায়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বেনজীর আহমেদের বিও অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বিএসইসি। মতিউর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন, অভিহিত বা প্রকৃত মূল্য হিসাবে এসব শেয়ারের দাম অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা। এর দু-একটি বাদে সব কোম্পানি আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় নেয়া এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন মতিউর রহমান। অপরদিকে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিও অ্যাকাউন্টও জব্দ করেছে বিএসইসি। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিগত সরকারের সময়ে পুঁজিবাজারে কী হয়েছে, তা অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা শ্বেতপত্রেই উঠে এসেছে। এটাকে এক কথায় লুণ্ঠন বলতে হবে। আর এ রাঘববোয়ালদের সহযোগিতা করেছেন বিএসইসি, ডিএসইর সেই সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, কমিশন এখন একের পর এক যেভাবে পুঁজিবাজার কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করে জরিমানা করছে, সেটি অব্যাহত রাখা উচিত এবং তাদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কমিশন এখন আইন অনুযায়ী কারসাজিকারীদের খুঁজে বের করার কাজ শুরু করেছে। আগেও এ সুযোগ ছিল। কিন্তু আগের কমিশন কেন সেই কাজটি করেনি, সে ব্যাপারে মুখ খুলতে চাচ্ছি না। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে কারসাজি করে যখন যারাই অর্থ লোপাট করেছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

পুঁজিবাজার থেকে কমেছে মূলধন সংগ্রহ:
চলতি বছরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে চারটি এবং কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে দুটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, দুটি ব্যাংক বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করেছে। ২০২৪ সালে পুঁজিবাজার থেকে মোট ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে তিনটি, কিউআইওর মাধ্যমে তিনটি, মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে একটি ও চারটি বন্ড ইস্যু করে মোট ১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছিল। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে পুঁজিবাজার থেকে ৪৬৭ কোটি টাকার কম মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে।

পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন: অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচ সদস্যের ট্যাক্সফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কমিটি গঠন করে বিএসইসি। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট টাক্সফোর্স সদস্যরা হলেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।

সূচক মূলধনের অবনতি:
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমে পাঁচ হাজার একশ পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ পুনর্গঠিত বিএসইসির দায়িত্ব নেয়ার দিন গত ১৯ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৪৯ পয়েন্টে। চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করেছে ৫ হাজার ২১৬ পয়েন্টে। তার মেয়াদের সাড়ে ৪ মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে প্রায় ৫৫৪পয়েন্ট বা ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক এক হাজার ৯৩৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। শরিয়াহ সূচক অবস্থান করে এক হাজার ১৬৮ পয়েন্টে।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি ৪২ লাখ ২ হাজার টাকা। ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২০৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকায়। প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে, চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি ২৯ লাখ টাকায়, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদিকে, চলতি বছরের ২৮ মে ডিএসইর বাজার মূলধন সর্বনিম্ন হয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫১ হাজার ২৮৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়।
মরিয়ম সেঁজুতি