রমজান মাস শুরু। দেশের অনেক এলাকাতেই ক্রিয়াশীল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। ভোটারদের আকৃষ্ট করার বহুবিধ ভাবনা নিয়ে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিএনপির বর্ধিত সভা মূলত নির্বাচন এবং তৃণমূলে সংগঠনকে এক্যবদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়েই করা হয়। বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছেন। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন রোববার বলেছেন, এখন দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। তবে এখনও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ও বিতর্ক আছে। একইসঙ্গে সংস্কার ইস্যু আছে। নির্বাচনের আগে সংস্কার কতটুকু হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি।
সামনের নির্বাচনে বিএনপি তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিল, তাদের কিছু আসন ছাড় দেবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনেরও কথাও বলা হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী যে আলাদা নির্বাচন করবে তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। ছোট ছোট ইসলামী দলগুলো আলাদা জোট করে নির্বাচনে নামতে পারে। জাতীয় পার্টি চাপে থাকলেও তারা নির্বাচন করতে চায়। আর সদ্যগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কীভাবে নির্বাচন করবে, তাদের গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির যৌক্তিকতা ইত্যাদি এখনও স্পষ্ট নয়। সবচেয়ে বেশি অস্পষ্টতা আওয়ামী লীগকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের যাদের নামে মামলা হয়েছে নির্বাচনে শুধু তারাই বাদ পড়বে, নাকি দল হিসাবে আওয়ামী লীগও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না- সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামাত নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে।
দক্ষিণের জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আল এমরান বলেন, এলাকায় বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী আছে। তারা নিয়মিত এলাকায় আসছেন, জনসংযোগ করছেন। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন। কে মনোনয়ন পাবেন তা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সবার জনসংযোগ অব্যাহত থাকবে। এর বাইরে জামায়াতও কাজ করছে। এই দুইটি দলের বাইরে অন্য কোনো দলের তেমন তৎপরতা নাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এখনও যারা এলাকায় আছেন, তাদের আমাদের দলে নেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে কয়েকটি ছোট ছোট ইসলামী দল তাদের কাছে টানছে। তারাও তাদের সঙ্গে সক্রিয় হচ্ছে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কিছুদিন পর থেকেই বিএনপি ও জামায়াত ধারাবাহিভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির কর্মসূচিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যোগ দিচ্ছেন। আর জামায়াতের কর্মসূচিগুলোতে দলের আমির ড. শফিকুর রহমান উপস্থিত থাকছেন। অন্যান্য দলও ধারবাহিক কর্মসূচি দিচ্ছে। তবে জাতীয় পার্টি এখন চুপচাপ আছে। আর আওয়ামী লীগের নির্ধারিত কোনো কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না।
দেশের দক্ষিণে মংলা উপজেলার বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ বলেন, আসলে আমাদের এখানে বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় আছে। আর কারুর তেমন তৎপরতা নাই। নতুন যে দল এনসিপি হয়েছে, তাদের যে নাগরিক কমিটি ছিল, আমাদের এলাকায় তারা মূলত জামায়াত-শিবরেরই লোক। উপজেলা পর্যায়ে কমিটি হলে তারা সবাই নতুন দলে যাবে কিনা জানি না। আর আমাদের পার্টির কাজ আছে। জনসংযোগ করি। তবে নির্বাচনের কাজ শুরু হবে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর।
মংলা পৌর বিএনপির আহ্বায়ক জুলফিকার আলী বলেন, আমাদের এলাকায় সম্ভাব্য তিন প্রার্থী আছেন। তাদের তিনজনকে নিয়েই আমরা কাজ করছি। আমরা ইউনিয়ন, গ্রাম সবখানেই যাচ্ছি। এরপর দল যাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে, তাকে নিয়ে আমরা কাজ করবো। আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তত। আমাদের এলাকায় জামায়াতও নির্বাচনের কাজ করছে। জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলের নির্বাচনি তৎপরতা নাই।
ওই একই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর পৌর আমির এম এ বারি বলেন, আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে। আমরা পরিকল্পিতভাবে কাজ করছি। দলের সিদ্ধান্ত হলো, সার্বিক প্রস্তুতি রাখা। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছি। তাদের খোঁজ-খবর রাখছি।
দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে প্রায় একই চিত্র পাওয়া যায়। প্রধানত বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ইসলামী দল নির্বাচনের কাজ করছে। চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলনও সক্রিয় আছে।
তবে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাও আছে তৃণমূলে। বিশেষ করে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে সে বিষয়ে অনেকেই এখনেও নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাই নির্বাচনের মাঠে থাকলেও অনেকে তেমন আগ্রহ পাচ্ছেন না।
সাতক্ষীরা-৪ আসনে মনোয়ন প্রত্যাশী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম বলেন, বর্ধিত সভায় আমাদের দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখা এবং তৃণমূলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে যাদের বিভিন্ন আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তারা সবাই নির্বাচনের জন্য তৎপর আছে। আমিও আমার এলাকায় প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করি, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে। তাপরও সংশয় থাকলে আমরা সারাদেশ থেকে ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রাখবো।
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুঁড়িগ্রাম থেকেও নির্বাচনি প্রস্তুতির খবর পাওয়া গেছে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের কেন্দ্র থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আমরা সংগঠনের সব ইউনিটকে সেই কাজে লাগাচ্ছি। এখনও প্রার্থীর ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। কোন এলাকায় কে প্রার্থী হবেন তা আরও পরে চূড়ান্ত করবে কেন্দ্র।
কুঁড়িগ্রাম জেলার জামায়াতে ইসলামীর আমীর মো. আব্দুল মতিন ফারুকী বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। রমজান মাসে আমরা ইফতার পার্টিসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনসংযোগ করছি।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, আপনি রাজনৈতিক দলের তৃণমূলে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বললেও আমি জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখছি না। নির্বাচন কমিশন ডিসসেম্বরে নির্বাচনের কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে বলছেন না। উপদেষ্টারাও নানা কথা বলছেন। নির্বাচনের জন্য আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির যে দরকার তা তো দেখছি না। আবার সংস্কার, নির্বাচন এসব নিয়ে বিতর্কও আছে।
তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচন চায় ডিসেম্বরের মধ্যে। জামায়াত তো চায় বলে মনে হয় না। আবার ছাত্রদের যে নতুন রাজনৈতিক দল হয়েছে, তারা তো নির্বাচন পিছাতে চায়। সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি আমি এখানও দেখছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে মানুষের সব সময়ই আগ্রহ আছে। তৃণমূলে সেই আগ্রহেরই প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু ডিসেম্বরে নির্বাচনের বাস্তবতা কতটুকু তৈরি হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তার কথা, অন্তর্বর্তী সরকার যে সময় পেয়েছে, তাতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারতো। কিন্তু কয় দিক তারা সামলাবে? তাদের সামনে নানা ইস্যু হাজির হয়েছে। যে আসামিরা কারাগার ভেঙে পালিয়েছে, যে গোলাবারুদ লুট হয়েছে, তা কি উদ্ধার হয়েছে? এই অবস্থায় নির্বাচন দিলে কী পরিস্থিতি হবে ভেবেছেন! আর তরুণদের যে নতুন দল হয়েছে, তারা তো নির্বাচন আরও পিছিয়ে দিতে বলছে। তাদের তো গণপরিষদ নির্বাচন, সংবিধান পরিবর্তন এসবের দাবি আছে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে