বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি বাস্তবায়ন থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যেখানে শহরাঞ্চলে ৫৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য থাকছে উন্মুক্ত অবস্থায়। যা দূষণ, জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
প্রয়োজন মতো আইন প্রণয়নের মারাত্মক পরিণতি ও একটি সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা—এমনকি বাংলাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দেখভালেরও একটি নিবেদিত কর্তৃপক্ষ নেই।
দেশের মেডিকেল বর্জ্য উত্পাদন প্রতি বছর আনুমানিক ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামগ্রিক বর্জ্য উত্পাদন প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। শুধু ঢাকায় দৈনিক প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা ২০৩২ সাল নাগাদ বেড়ে সাড়ে ৮ হাজার টনে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদিন ১৫ লাখ টনেরও বেশি কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় এবং ১০ শতাংশেরও কম পুনরায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
‘হেলথকেয়ার ওয়েস্ট ইন বাংলাদেশ: কারেন্ট স্ট্যাটাস, দ্য ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯’ এবং সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট উইথ লাইফ সাইকেল অ্যান্ড সার্কুলার ইকোনমি ফ্রেমওয়ার্ক শীর্ষক এক গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, কোভিড-১৯ ও অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা বাদ দিলে ২০২৫ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৫০ হাজার টন মেডিকেল বর্জ্য (প্রতি শয্যায় ১ দশমিক ২৫ কেজি) উৎপন্ন করবে। যেগুলোর মধ্যে ১২ হাজার ৪৩৫ টন বিপজ্জনক হবে।
২০২২ সালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রতি শয্যায় মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ ১ দশমিক ৬৩ কেজি থেকে ১ দশমিক ৯৯ কেজি। কোভিড-১৯ মহামারির পরে এটির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও স্থায়ী চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কক্সবাজার জেলায় পাঁচটি মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা স্থাপন করেছে। এ ধরনের উদ্যোগ সত্ত্বেও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এলাকায়।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে মাসিক গোলটেবিল আলোচনা সিরিজ এসডিজি ক্যাফের ১২তম পর্বের আয়োজন করে ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস (ইউএনওপিএস) বাংলাদেশ।
২০২৪ সালের ৩ অক্টোবরের এই অনুষ্ঠানে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা– বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান অন্বেষণ করা হয় এবং এসডিজি ১১, ১২ ও ১৩ তুলে ধরা হয়। এর লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিরোধ, হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করা।
টেকসই সমাধানের উপর বিশেষজ্ঞদের অভিমত
অনুষ্ঠানটিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রওশন মমতাজ। তিনি তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংকটের বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি একটি বড় পরিবারের বর্জ্য পৃথকীকরণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে উল্লেখ করেন, প্রতি ১৫ বছরে বর্জ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, পৃথকীকরণের অভাব ও দুর্বলভাবে পরিচালিত ল্যান্ডফিলগুলো পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে আরও বাড়াচ্ছে।
ড. মমতাজ তিনটি আর অর্থাৎ হ্রাস, পুনঃব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার ওপর জোর দিয়েছেন। অতিরিক্ত উত্পাদক দায়বদ্ধতা (ইপিআর) অবশ্যই একটি টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো বিকাশের জন্য বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।
ইউএনওপিএস বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সুধীর মুরালিধরন বলেন, ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু নিষ্পত্তি নয়; এটি আমাদের ভোগের ধরনগুলো পুনরায় আকার দেওয়া ও স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ও।’
যদিও মেডিকেল বর্জ্য বাংলাদেশের মোট কঠিন বর্জ্যের মাত্র ১ শতাংশ হলেও এর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পুরো বর্জ্য প্রবাহকে দূষিত করে ও বিপজ্জনক করে তোলে।
নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও এর সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশ সরকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলন বাড়ানোর জন্য জাতীয় থ্রিআর কৌশল প্রণয়ন করেছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উন্নত করতে এসব কৌশল অন্তর্ভুক্ত করেছে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১-এ প্রথমবারের মতো এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) চালু করা হয়েছে।
এই বিধিমালা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নিবেদিত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর পরিবর্তে প্রিজম বাংলাদেশ, ওয়েস্ট কনসার্ন, সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএসডি), এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) এবং আইসিডিডিআর,বি’র মতো সংস্থাগুলো মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে ঢাকায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকে।
মেডিকেল বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, হাসপাতালের কিছু কর্মী সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য মেডিকেল বর্জ্য (যেমন কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ ও ব্লাড ব্যাগ) অসাধু পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের কাছে বিক্রি করে। একটি চক্র ওষুধের দোকান, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বিক্রি করার আগে প্রয়োজনীয় জীবাণুমুক্তকরণ ছাড়াই এই উপকরণগুলো পরিষ্কার ও পুনরায় প্যাকেজ করে বলে জানা গেছে।
২০০৮ সালের মেডিকেল বর্জ্য (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট) বিধিমালা অনুসারে, হাসপাতালগুলোকে পুনরায় ব্যবহার রোধ করতে প্লাস্টিকের টিউব ও অন্যান্য বর্জ্য উপকরণগুলো কেটে বা ছিদ্র করে দিতে হয়। তবে টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ হাসপাতালে এই নিয়ম মানতে ব্যর্থ হয় এবং ৪৯ শতাংশ হাসপাতালে সুই ধ্বংসকারী যন্ত্রের অভাব রয়েছে।
২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত ‘গভর্নেন্স চ্যালেঞ্জেস ইন মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক এক গবেষণায় ৪৫টি জেলার হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষসহ ৯৩টি মেডিকেল বর্জ্য কর্মী ও ২৩১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মকানুন মেনে না চলা এবং তদারকির অভাব রয়েছে।
যদিও ২০০৮ সালের বিধিমালা প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। এর পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ও হাসপাতালগুলো লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদারদের কাছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আউটসোর্স করেছে।
স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব
ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ইউএনবির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে চায় না। অনেক হাসপাতাল এখনও উচ্চ বাছাই ব্যয় ও প্রয়োগকারী ব্যবস্থার অভাবের কথা উল্লেখ করে সাধারণ আবর্জনা হিসাবে বর্জ্য অপসারণ করে।
তাছাড়া মেডিকেল বর্জ্য ট্র্যাক করার কোনো কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ নেই। গবেষণায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মও উঠে এসেছে। সরকারি হাসপাতালে চাকরির জন্য এক থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব অগ্রগতিকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে। আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার কারণে বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির অনেকাংশেই অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।
জরুরি সংস্কারের আহ্বান
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান পদ্ধতিগত সুশাসন ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে জবাবদিহিতার অভাব রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় এবং প্রতিটি পর্যায়ে পরিবেশ বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পরিবেশ ও সেবার মান উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয় হাসপাতালেই কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার সংস্থা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে অধিকতর সচেতনতা, উন্নত কারিগরি সহায়তা ও সমন্বয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।
কর্তৃপক্ষ, টেকসই মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যমান নিয়ম-কানুনের কঠোর প্রয়োগ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) বৃদ্ধি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলোতে সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য আরও ভাল পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছে।
অবিলম্বে সংস্কার ও একটি নিবেদিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা না হলে— মারাত্মক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।