লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে মধ্যবিত্তের পকেটে টান 

শফিকুল ইসলাম। চাকরি করেন ঢাকার একটি প্রাইভেট ফার্মে। ১১ বছরের একমাত্র মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তিন সদস্যের সংসার তার। স্ত্রী জিনাত আরা সানজিদাও চাকুরীজীবী। দুইজনের আয়েও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন সংসারের খরচ মেটাতে।

ক্ষোভ আর হতাশা মেশানো কণ্ঠে শফিকুল ইসলাম বলেন, গত চারদিনে দুই দফা বাড়লো মুরগির দাম। আজকে ২৩০ টাকা চাইছে ব্রয়লারের দাম। এখন শুধু ডিমের পেছনেই মাসের বাজেট ধরতে হচ্ছে ১৫০০-১৭০০ টাকা। চাল-ডাল, মাছ, সবজী; সবকিছুর দাম বাড়তি। স্বামী-স্ত্রী মিলেও খরচ সামলাতে পারছি না। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য করা ডিপিএস ভেঙেও কুলাবে না।

শুধু শফিকুল ইসলামই নন; বাজার ঘুরলে এমন ক্ষোভ আর হতাশামাখা চেহারা চোখে পড়ে অহরহ। ক্রেতা-বিক্রেতার বাক-বিতণ্ডাও ইদানিং চোখে পড়ছে বেশি বেশি। এমন হবে নাই বা কেন? মাত্র এক সপ্তাহে তিন দফায় বেড়ে ডাবল সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। একদিন আগেও যে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে মঙ্গলবার বিভিন্ন বাজারে ওই মুরগির জন্য ২১০-২৩০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা। দেশি মুরগির দামও চাওয়া হচ্ছে ৬৫০-৬৮০ টাকা প্রতি কেজি। অন্যদিকে সোনালী বা পাকিস্তানি কক বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৫০ টাকায়।

মধ্যবিত্তের পাতে সবচেয়ে সাধারণ যে ডিম, তার দামও ইতোমধ্যে নাগালের বাইরে। গত এক সপ্তাহে তিন দফা বেড়েছে মধ্যবিত্তের পুষ্টির সবচেয়ে সহজলভ্য এই যোগানদাতার দামও। সবশেষ মঙ্গলবার প্রতি ডজন ডিমের দাম পৌঁছেছে ১৮০ টাকায়। কোনো কোনো খুচরা বিক্রেতা চাইছেন ১৮৫ টাকাও।

ডিমের দামের এমন ডিগবাজীতে হতভম্ব ক্রেতা সাধারণ। শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারে দেখা হওয়া হায়দার হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, ভারত থেকে বাকি ৭ টাকার ডিম আসছে। তাহলে ডিমের দাম ১৮০ কেন? বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বেশ ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে চালের দামও কমার লক্ষণ নেই। সব থেকে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭১-৭২ টাকা, আটাশ ৫৭-৫৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকা, পাইজাম ৫৬-৬০ টাকা, সুগন্ধী চিনিগুঁড়া পোলাও ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভোক্তারা বলছেন, দেশের পটপরিবর্তন হলেও জনসাধারণের ভাগ্য পরির্বতন হয়নি। উল্টো প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের।

আগুন লেগে আছে সবজির বাজারেও। সবশেষ মুলার কেজিও ছুঁয়েছে ১০০ টাকা। গাজরের কেজি ১২০ টাকা। এমনকি সব তরকারির আলুও ৭০ টাকা কেজি। করল্লার কেজি ৮০-১০০ টাকা, বেগুনের কেজি ৭০-১০০ টাকা, চিচিঙ্গা-পটল-ঝিঙার কেজি ৬০-৮০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০-৮০ টাকা, ঢেড়শ ৬০-৭০ টাকা। মোট কথা, বাজারে একটু তাজা সবজী কিনতে গেলেই ৭০-৮০ টাকার নিচে পাচ্ছেন না ক্রেতারা। যা একটি সস্তায় মিলছে কাঁচা পেঁপে; কেজিপ্রতি দাম চাওয়া হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা।

বিক্রেতারা বলছেন, বন্যার কারণে সরবরাহে ঘাটতি, তাই দাম বেড়েছে সবজির। কিন্তু ক্রেতা সাধারণ দুষছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে। অনেকে বলছেন, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে শুনে একটু আশা দেখেছিলাম, কিন্তু এখন শুধুই হতাশা। সরকার শুধু মুখে মুখেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। সাধারণের কষ্ট দূর করার নাম নেই।

একই অবস্থা মাছের বাজারেও। ২৬শ-২৭শ টাকার ইলিশের দিকে তাকানোর ভুল করেন না বেশিরভাগ ক্রেতা। চাষের রুই-কাতলার কেজিও ৪০০ টাকা। চাষের কই কেজিপ্রতি ২৮০-৩০০ টাকা, শিং-মাগুর কেজিপ্রতি ৪৫০-৬০০ টাকা, বোয়াল ৭০০-৯০০ টাকা, আইড় ৭০০-৮০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকা। নাগালের মধ্যে যা একটু পাঙাশ-তেলাপিয়া। প্রতি কেজি চাষের পাঙাশ ২৮০-৩০০ আর তেলাপিয়া ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এখন।

মাছ বিক্রেতারা বলছেন, সহসাই এই দাম কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। আড়ত থেকে বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে তাদের। আর ইলিশের দাম আকাশ ছোঁয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তারা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন সরকারের ইলিশ রপ্তানিকে।

উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতি তদারকি এবং পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।