সমন্বয়ের অভাবে টালমাটাল নিত্যপণ্যের বাজার

রমজান মাসে বেশিরভাগ পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকলেও এখন তা বাড়তে শুরু করেছে। গেল তিন দিনের ব্যবধানেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ টাকা। আর সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ১৪ টাকা। এছাড়া, বাজারে রয়েছে ভোজ্যতেলের সংকট। সবজির বাজারও চড়া। বিক্রেতারা বলছেন, সবজির সরবরাহ কম, তাই দাম বাড়ছে।


সারাবছরই বাজারে এক পণ্যের দাম কমে তো আরেক পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অথচ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে একটি। এরপরেও আমরা খাদ্যে স্বংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা দেশটিতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামাল রয়েছে হাতের নাগালে। শ্রমের মূল্য অনেক সস্তা। এরপরেও গত দুই বছরে দেশে জনগণের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে স্বস্তি না পাওয়ায় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে। চাহিদা অনুপাতে যোগান না থাকায় বাজারে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। আর বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এ সিন্ডিকেটগুলোর কারণে দফায় দফায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। দাম কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও স্বস্তি ফেরেনি ভোক্তাদের। রমজান শুরুর পর কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে আসলেও ঈদ সামনে রেখে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যে কোনো উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ফলাফলের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ফলাফলের নিরিখে এখনো বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহে তথ্যগত ঘাটতি রয়েছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টিকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি বলে মনে করেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত পণ্য পৌছাতে হাতবদলের পরিমান কমাতে হবে। এছাড়া পণ্য সংরক্ষনের জন্য সরকারকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। পাশাপাশি কৃষিতে উৎপাদিত ফসল নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে আনা, উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহেরও পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান এ প্রসঙ্গে বলেন, সিন্ডিকেট সাধারণত সবজির ক্ষেত্রে কার্যকর থাকে না। কারণ সবজি পচনশীল। তবে চাল, তেল, ডাল, আলু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হয়। তিনি বলেন, সরকার শুধু সিন্ডিকেট ভাঙবো বলে বসে থাকলে হবে না। সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারকে বাজারে ঢুকতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য বাজারে প্রচুর পরিমানে পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে যে ৫-৬ কোম্পানি বাজারে সিন্ডিকেট করছে তারা আর সাহস করবে না।

ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফসলের চক্রটা হচ্ছে এমন যে আমরা শীতকালীণ সবজির উপরেই নির্ভর করি বেশি। কারণ শীতকালে সবজির উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু উৎপাদন ভালো হলেই দাম পড়ে যায়। সমস্যা হচ্ছে আমাদের ফেসিলিটি কম। উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে যাবেÑ এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বেশি দাম পড়ে যায়, যা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এজন্য প্রয়োজন ছিল সংরক্ষণ ফেসিলিটি বাড়ানো। কিন্তু তা হয়নি।

এ কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের ল্যান্ড বাজেটিং ঠিকভাবে করা হয় না। এটাও একটি সমস্যা। কারণ কখনো কখনো সবজির ক্রাইসিস দেখা দেয়। তখন দাম বেড়ে যায়। দাম বেড়ে গেলেই পরবর্তী বছরের জন্য কৃষক ফসল বেশি ফলায়। এটা একটি কমন থিওরিÑ ‘দাম বাড়লে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বাড়লে দাম আবার পড়ে যায়। পরবর্তী সিজনে উৎপাদন আবার কমে যায়’। এজন্য আমাদের সংরক্ষণ ফেসিলিটি বাড়ানো প্রয়োজন এবং ল্যান্ড বাজেটিং সঠিকভাবে করতে হবে। কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে যে কী পরিমান জমি তারা সবজির জন্য ব্যবহার করবে।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ সালে আলুর উৎপাদন কম হয়েছিল। যদিও বলা হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ৮০-৯০ লাখ টনের বেশি উৎপাদন হয়নি। যে কারণে আলুর দাম বেড়ে গেছে এবং আলু আমদানি করতে হয়েছে। আলু দাম প্রায় ৮০- ৯০ টাকা কেজি হলে কৃষকরা উৎসাহী হয়ে এ বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ জমিতে আলু বেশি উৎপাদন করেছেন। আশা করা হচ্ছে ১ কোটি ২০ লাখ টন আলু উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদন বেশি হলে আলুর দাম পড়েই যাবে। যা বর্তমান বাজারে প্রমাণিত। কৃষকরা বলছে, আলু উৎপাদনে ২০-২৫ টাকা খরচ হতে পারে, সেখানে আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকা। যা সাংঘাতিক দরপতন। আমাদের পলিসি হওয়া উচিত ছিল কৃষকদের কাছ থেকে বেশি করে আলু কিনে নেয়া। ১০ থেকে ১৫ লাখ টন আলু যদি সরকার এখন সংরক্ষণ করতো তাহলে দাম স্বাভাবিক হতে। যে কোলেস্টরলগুলো রয়েছে সেখানে প্রকৃত কৃষক গিয়ে জায়গা পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ঘোষণা দেয়া যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জায়গা প্রকৃত কুষবদের দেয়া। জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ২৩ টি ফসল প্রকিউরম্যান করা হয়। এর মধ্যে আলু এবং পেঁয়াজ অন্যতম। আমাদের দেশে ধান ও গম ছাড়া আর কিছুই প্রকিউরমেন্ট করা হয় না।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। ছাত্র-জনতার অভুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাবার অন্যতম কারণ ছিল, বাজারে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা। কারণ ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে কিন্তু বাংলাদেশ অন্যতম ব্যতিক্রম। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকে বড় দুটি অগ্রাধিকার ঘোষণা করে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যায় গত সরকারের আমলে অর্থনীতির অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ার প্রভাব, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া, সাম্প্রতিক বন্যা ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা অর্থনীতি বহির্ভূত কারণ যেমন- পণ্য পরিবহণে চাঁদাবাজি কিংবা সিন্ডিকেটের কথাও বলছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি ও অভিযানের পরও পবিত্র রমজানেও ক্রেতারা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পাননি। নিত্যপ্যণের বাড়তি দাম তাদের জীবনকে আরো কঠিন করে দিয়েছে। আমদানি করা বেশিরভাগ ডালজাতীয় পণ্যের দাম গত দুই মাসে সাড়ে ১৩ শতাংশ ও রোজার মাসের প্রথম নয় দিনে সাড়ে ২৩ শতাংশ বেড়েছে। ইফতারের আরেক জনপ্রিয় উপকরণ খেজুরের দামও বেড়েছে। জিলাপির প্রধান উপকরণ চিনির দাম স্থির ছিল। ভোজ্যতেল কেনার সময় ক্রেতারা কোনভাবেই তার নাগাল পাচ্ছে না।

সরকারি তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি উচ্চতর পর্যায়ে আছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে এটি নয় শতাংশেরও বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বিদায়ী ২০২৪ সালের সর্বশেষ মাসের মূল্যস্ফীতি তথ্য প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরের চলন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪৮। আর চলতি বছরের শুরুর মাস জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর জন্য বারবারই অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেন। দাম বাড়ানোর চক্রান্ত হলেই তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেন। আর বেশি দাম দিলে পণ্য পাওয়া যায়। সরকারের সাথে আলোচনার আগেই ব্যবসায়ীরাই সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন, সরকারকে চাপে ফেলে সেই দাবি তারা পূরণ করে সরকার শুধু বৈধতা দেয় মাত্র।
ক্যাব সেক্রেটারি বলেন, আমরা যারা ভোক্তা তারা বাজার থেকে পণ্য বেশি দামে কিনছি, আবার কৃষক যিনি উৎপাদন করছেন, তিনি কম দামে বিক্রি করছেন। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই দেখে আসছি যে, পণ্য হাতবদল হলেই দাম বাড়ে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমরা কৃষকের কাছাকাছি হাটের বিষয়ে বলেছিলাম। কৃষক যদি সরাসরি বিক্রি করার সুযোগ পায়, হাতবদল যদি কমানো যায়- তাহলে হয়তো কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে। আবার বগুড়া বা রংপুর, অর্থাৎ যেখান থেকে আমাদের সবজি বেশি উৎপাদন হয়, সেখান থেকে যেন কৃষকরা বুলেট ট্রেণের মাধ্যমে ঢাকায় পণ্যগুলো আনতে পারে। তাহলে কৃষকের ভোগান্তি কমবে, চাঁদাবাজি কমবে। নাজের হোসেইন আরো বলেন, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের আরো কিছু সংরক্ষণাগার তৈরি করা প্রয়োজন। কৃষকরা উৎপাদন খরচ তুলতে দাদন দিয়ে পণ্য বিক্রি করে ফেলে। তাই আগে কৃষককে ঋণ সাপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও জানান তিনি।