শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ ‘তছরুপ’ হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে একটা উন্নয়ন আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, যার আড়ালে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে অধিক পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে দেশের অর্থনীতির হালচাল জানার জন্য গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সব মিলিয়ে এখন দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে। প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে ‘পাচার’ হয়েছে বলেও কমিটির পক্ষ থেকে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন শ্বেতপত্র কমিটি সংবাদ সম্মেলনে কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান। সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সব সদস্য সংক্ষেপে প্রতিক্রিয়া জানান। এর আগে গত রোববার দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রতিটি খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, এখানে ব্যক্তির দোষ খোঁজা নয়; আমরা একটা প্রক্রিয়া তুলে ধরেছি। আমাদের কাজ চোর ধরা না, আমরা চোরের বর্ণনা দিয়েছি। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। এর উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিতা নষ্ট করা হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বলেন, গত ১৫ বছরে দুর্নীতি বা অনিয়ম যাই বলেন এর পেছনে রয়েছে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং উর্দিপরা ও উর্দিছাড়া আমলাগোষ্ঠী। বিগত তিনটি নির্বাচন এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সরকার ও সামাজিক শক্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এমনকি বিদেশিরাও এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বিদেশিরা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা করে সরকারকে সুরক্ষা দিয়েছে।
তিনি বলেন, এখন সংস্কার কাজের জন্য দেশে অর্থনৈতিক ও আইন শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা দরকার। সরকার গত তিনমাসে অর্থনীতি ঠিক করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার একটি বিস্তারিত বিবরণ জনসম্মুখে দিতে হবে। আগামী ছয়মাসে যেসব পদক্ষেপ সরকার নেবে বলে মনে করছে তারও একটা পরিকল্পনা হাজির করতে হবে। আগামী ছয়মাসে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার মান, সুদহার কোনটা কোথায় থাকবে তার একটা ধারণা সরকারকে দিতে হবে।
দেবপ্রিয় বলেন, বর্তমান সরকার সীমিতকালীন সরকার হলেও এর সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। বিনিয়োগ ও কর্সংস্থান, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা এসব খাতে একটি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা এ সরকারকে দিতে হবে। সেটা দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হলেও হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য ড. এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ ব্যয় তছরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে। এটা এককভাবে ঘটেনি। সব পক্ষ মিলে ধাপে ধাপে কাজটি করেছে।
ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক মেগা প্রকল্পই হয়ত প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঠিকাদারের কথা অনুযায়ী কয়েকগুণ ব্যয় বাড়িয়ে সেই টাকা পাচার করা হয়েছে। অর্থপাচারের হিসাব বের করা বেশ কঠিন। তবে আমি একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পাচারের হিসাবটা এনেছি।
ড. ইমরান মতিন বলেন, দরিদ্রের যে উন্নতির কথা বলা হয়েছে, সেটা অর্থবহ নয়। কারণ যারা দারিদ্র্যসীমার উপরে আছে, তারা যদি দুই দিন কাজ করতে না পারে, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। টোকা দিলেই পড়ে যাবে এই ধরনের একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন দুর্নীতির রাজপথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সংকট মোকাবিলার জন্য প্রথমে বলা হলেও পরে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার হয়েছে। নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনের প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি প্রণয়ন করে দুর্নীতি করা হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখন গবেষণার দাবি রাখে। অতীতেও এর বিরুদ্ধে সংস্কারের দাবি উঠেছে, বিরোধিতাও এসেছে। এখনও নানাভাবে সংস্কারবিরোধীরা সক্রিয়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কথা চিন্তা করলে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সংস্কার করতেই হবে।
ড. আবু ইউসুফ বলেন, রাজস্ব বোর্ড যে পরিমাণ টিন সার্টিফিকেট থাকার দাবি করে, সেই পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে সেই সার্টিফিকেট বা নম্বর কি হবে, সেটির কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। রাজস্ব বোর্ড সেটা কমিটিকে দিতে পারেনি। কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা খাতকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে তার কোনো সঠিক কাঠামো নেই।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এত দিন ভেবেছিলাম, আমাদের মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার শঙ্কা আছে, ঝুঁকি আছে। এখন আমরা বলছি, আমরা সেই ফাঁদে পড়ে গেছি। পরিসংখ্যান দিয়ে এত দিন উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। হিসাব গরমিলের কারণে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছি।
তিনি বলেন, এ দেশে জিডিপি যেভাবে হিসাব করা হয়, তাতে অতিরিক্ত দেখা যায়। কোনো খাতে মূল্য সংযোজন বাড়লে ধরা পড়ে, কিন্তু কমলে ধরা পড়ে না। তথ্য-উপাত্ত বলছে, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়িনি, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বিগত সরকারের আমলে এত টাকা পাচার হলো, কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হলো না, কর্মসংস্থান হলো না, তাহলে এত প্রবৃদ্ধি হয় কীভাবে। তিনি আরও বলেন, নীতি সংস্কার করতে হবে। জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে এ কমিটি গঠন করে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ২৮ অগাস্ট কমিটি হওয়ার পরপরই কাজে নেমে পড়ে কমিটি। এই সময়ের মধ্যে ১৮টি বৈঠক, ২১টি পলিসি কনসালটেশন, ১৫টি কারিগরি কমিটির বৈঠক এবং তিনটি গণশুনানির আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এসব কাজ করার জন্য অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয়’র নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কোনো ভাতা নেয়নি, এমনকি বৈঠক বাবদ সম্মানিও কমিটির সদস্যরা নেননি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনার আলোকে কমিটির সদস্যদের নিজেই নির্বাচিত করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কমিটি মনে করছে, প্রচলিত বাজার অনুযায়ী এই ধরনের একটি গবেষণাকাজের জন্য ২৫ কোটি টাকা খরচ হতে পারত। প্রথাগত গবেষণা পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকরা নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান এখানে ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে।