#ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ
মরিয়ম সেঁজুতি: আজ মঙ্গলবার পঞ্চম দিন অতিক্রম করলো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে সংঘাতের তীব্রতা। মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান সামরিক শক্তির এই সংঘাত যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে, তখন এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক আর্থিক খাত ও বিমান পরিবহন শিল্পে। ইসরায়েলের আকস্মিক হামলায় গত শুক্রবার ইরানে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে শেয়ারবাজারে, যদিও পরে তা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। তবে যুদ্ধ যত তীব্র হচ্ছে, ততই বাড়ছে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা।
আভ্যন্তরীণ অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক বর্তমানে নেতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বৈশ্বিক অস্থিরতা তৈরি করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
আরও পড়ুনঃ ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ পোশাক শিল্পের নতুন চ্যালেঞ্জ: বিজিএমইএ সভাপতি
অর্থনীতিবিদদের মতে, ইরান ও ইসরাইল দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুব বেশি নেই। তবে এ যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। আর যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি খাতে প্রভাব পড়বে। প্রথমত, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব খাতে প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, প্রভাব ফেলবে বৈদেশিক শ্রমবাজারে। সর্বশেষ হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি খাতসহ পুরো আমদানি পণ্য সরবরাহে প্রভাব পড়বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিক সংঘাত নয়- এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল, রফতানিনির্ভর ও জ্বালানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই সরকার ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি, যাতে সম্ভাব্য অভিঘাতের ঝুঁকি কমানো যায়।
যদিও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। তবে স্বাভাবিকভাবেই কোনো যুদ্ধ হলে তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। মঙ্গলবার ক্রয় ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, সার এখন পর্যন্ত চলতি দামেই আমদানি করা হচ্ছে। প্রস্তুতি হিসেবে এলএনজি ও সার আমদানির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। আমার ধারণা যুদ্ধ বেশি দিন হবে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, শুধু এলএনজি নয় অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লেও আপাতত দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আমদানির ৩০ শতাংশই তিন ধরনের পণ্যে। এর মধ্যে রয়েছে-জ্বালানি তেল, খাদ্য এবং সার। এই পণ্যগুলোর অধিকাংশই হরমুজ প্রণালি দিয়ে আমদানি হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য খুব সামান্য। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ও ইরান একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এরপরও সম্পর্ক খুব বেশি এগোয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অংশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আবর, সংযুক্ত আবর আমিরাত, কাতার এবং ওমানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইতোমধ্যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে এই যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এই প্রভাবের গভীরতা নির্ভর করবে, যুদ্ধ কতটা দীর্ঘ স্থায়ী হয় তার ওপর।
তিনি বলেন, এখানে কয়েকটি শঙ্কা আছে। প্রথমত, বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এসব জ্বালানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি হয়। এর মধ্যে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) এবং ক্রুড অয়েল (অশোধিত তেল) অন্যতম। দ্বিতীয় বিষয় হলো শ্রমবাজার। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে। গত কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, এতে বড় কৃতিত্ব রেমিট্যান্সের (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ)। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হলে রেমিট্যান্স কমবে। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় আঘাত করবে। তৃতীয়ত, ইতোমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে ইরান। এটি বন্ধ হলে তেল সরবরাহে প্রভাব পড়বে। এর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। বাড়বে পরিবহণ ভাড়া, পণ্যের উৎপাদন খরচ। মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এছাড়া সরকার জ্বালানি তেলের যে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করছে, সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে যুদ্ধ কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তার ওপর।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা চাহিদা কমবে, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও শিপিং ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। দেশে আমদানি পণ্যের অধিকাংশই জ্বালানি তেল, তাই পণ্যটির দাম বাড়লে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো শ্রমবাজার। এখানে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ ইসরাইলে বাংলাদেশের শ্রমিক না থাকলেও ইরানে কিছু আছে। তবে এই দুই খাতেই সরাসরি প্রভাবের আশঙ্কা কম। তিনি আরো বলেন, এ যুদ্ধে বাংলাদেশ কোন পক্ষকে সমর্থন করবে, সেটি একটি প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে ইসরাইলকে সমর্থন করার প্রশ্নই আসে না। তবে মুসলিম দেশ, এই বিবেচনায় ইরান কিছুটা সহানুভূতি পেতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সংগঠনটির নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, ইরান-ইসরায়েল ‘যুদ্ধ’ বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, এ সংঘাতের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক খাতে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ সুদহার, মূল্যস্ফীতি, দুর্বল অবকাঠামো, মজুরি ও জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির চাপে আমরা নিষ্পেষিত। এর মধ্যেই ইসরায়েল-ইরান ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। যুদ্ধের ফলে যদি তেলের দাম বেড়ে যায়, তবে এর প্রভাব পোশাক খাতেও পড়বে। মাহমুদ হাসান খান বলেন, এ অবস্থায় প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ।