দেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হচ্ছে। যদি বিগত আওয়ামী লীগ আমলে পাচার করা অর্থের হিসাব করা হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা।
শনিবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ কার্যালয়ে) ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উপায়’ বিষয়ে আয়োজিত সেমিনারে এসব তথ্য জানানো হয়।
ইআরএফ ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সেমিনার আয়োজন করে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। অনুষ্ঠানে গ্রিনওয়াচ ঢাকার সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে মোট কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যবহার করে ১৭ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচারের কথা জানা যায়। তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। দেশের ব্যাংক খাতকে যে খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার পেছনে মূল দায়ী হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানের মৌলিক সংস্কার ও ঢেলে সাজানো ছাড়া বিকল্প নেই।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। যেখানে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী সবাই সহায়তা করেছে। বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ অর্থগুলো পাচার হয়েছে।
বিদেশি সংস্থাগুলো তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের মধ্যে বছরের ৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি রপ্তানি মাধ্যমে চলে গেছে।
আমাদের দেশে যারা বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের আয়ের একটা উৎস বিদেশে চলে যাচ্ছে এই মাধ্যমে বছরে ৩ বিলিয়নের মতো অর্থ পাচার হচ্ছে।
আরেকটি মাধ্যম হলো বাংলাদেশ থেকে যারা বিভিন্ন দেশে কাজ বা পড়ালেখার জন্য যায়, তাদের বড় একটি অংশ অবৈধভাবে জিম্মি হয়ে ভিসা ও কাজের জন্য আর্থিক চুক্তি করে যায় এই মাধ্যমে ২.২ বিলিয়ন ডলার চলে যায়। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
শুধু মুখের কথায় অর্থ পাচার রোধ হবে না জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থ পাচার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, বিএফআইইউ—এসব প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার পথনকশা আছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে, শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু আইনেরও প্রয়োজন আছে। এছাড়া দুর্নীতি বন্ধে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েস্ট সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া এবং আর্থিক অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করায় এখন গুরুত্ব দিতে হবে। এসব উদ্যোগ নিলে পাচার হওয়া টাকার পুরোটা না হলেও কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এতে ভবিষ্যতে পাচার করার বেলায় সবাই সাবধান হয়ে যাবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাবশালীরা পাচার করা অর্থ হজম করে ফেললে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। সে জন্য পাচারকারীদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাচারের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।