#নেই নতুন প্রকল্পের কাজ
#ফ্ল্যাট বিক্রিতে ধস, ছাঁটাইয়ের শঙ্কা
দেশের আবাসন খাতে স্থবিরতা চলছে। মূলত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) সমস্যার কারণে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব কারণে রাজধানীতে ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি এক বছরের ব্যবধানে ২০ শতাংশ কমেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়েছে। পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত রড ও সিমেন্টের মতো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এতে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে গেছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। ফলে নির্মাণকাজের প্রধান দুই উপকরণ রড ও সিমেন্টের বিক্রিতে ধস নেমেছে। একদিকে ফ্ল্যাট বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া, অপরদিকে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে না পারার কারণে বেশিরভাগ আবাসন প্রতিষ্ঠান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেÑ অনেক ডেভেলপার প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করছেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এমনকি কেউ কেউ নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আবাসন খাতে এক ধরনের স্থবিরতা এসেছে। ড্যাপের মাধ্যমে উচ্চতা ও ঘনত্বের সীমাবদ্ধতা এমনভাবে আরোপ করা হয়েছেÑ যা বেশিরভাগই বৈষম্যমূলক ও বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা ২০০৮ সালের ড্যাপের মতো উচ্চতা সীমা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে আবাসন খাতের গতি ফেরে। তিনি বলেন, ড্যাপ অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা ও আয়তনে কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় বর্তমানে জমির মালিকরা তাদের জমি ডেভেলপারদের কাছে হস্তান্তর করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। এতে নতুন আবাসন প্রকল্প শুরু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যা শুধু আবাসন খাতই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২০০টিরও বেশি লিংকেজ শিল্পে মারাত্মক মন্দা সৃষ্টি করেছে। রিহ্যাব সভাপতি আরো বলেন, রড, সিমেন্ট, ইট, কেবল, রং, টাইলস, লিফট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, স্যানিটারি সামগ্রীসহ আবাসন-নির্ভর শিল্পগুলো চরম ধসের মুখে। চাহিদা না থাকায় রডের বাজার ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন হ্রাসে বাধ্য হচ্ছে, শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাইও। এ খাতে সরাসরি প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কর্মরত, আর পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন অন্তত ২ কোটি মানুষ। এ সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে এর প্রভাব হতে পারে আরো ভয়াবহ। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনীতির এক বৃহৎ খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
ড্যাপ বাস্তবায়নে ধাক্কা : হ্রাস পাচ্ছে আয়তন, থমকে যাচ্ছে প্রকল্প : ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা ‘ড্যাপ’ নামে পরিচিত। ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে এটি কার্যকর করা হয়। কিন্তু শুরু থেকে ড্যাপ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক। বর্তমানে আবাসনশিল্পে যে সংকট চলছে তাতে প্রধান সমস্যা এই ড্যাপ। এটি আবাসন খাতের জন্য মারণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরনো নিয়মে যেসব এলাকায় ১০ তলা বা তার বেশি ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল, সেখানে এখন ৫ থেকে ৬ তলার অনুমোদন মিলছে। আয়তনের এই হ্রাস জমির মালিকদের অনাগ্রহী করে তুলেছে যৌথ প্রকল্পে। ফলে নতুন প্রকল্পের সম্ভাবনাও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
মন্দার গ্রাসে ফ্ল্যাট বিক্রি: রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) পরিচালক আইয়ূব আলী জানান, গত কয়েক মাসে ফ্ল্যাট বিক্রি গড়ে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। বড় প্রতিষ্ঠান কিছুটা টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি ডেভেলপাররা বেতন, অফিস ভাড়া ও কিস্তি পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ নির্মাণ ব্যয়ের নিচে গিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন, শুধু চলতে পারার জন্য। ক্রিডেন্স হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুল করিম বলেন, নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এটা হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘ড্যাপ’ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান)। জমি পাওয়া যাচ্ছে না, নকশা পাস করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাজউক কর্মকর্তারাও অনেক সময় স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিতে পারছেন না। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে চাহিদা কমেছে আরো বেশি। বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান বলেন, বেশি দামের ইউনিটগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে মাঝারি দামের ফ্ল্যাট কিছুটা বিক্রি হচ্ছে। কারণ সেগুলোর চাহিদা নির্ভর করে বসবাসের প্রয়োজনীয়তার ওপর।
কম দামে উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট বিক্রি : নির্মাণসামগ্রীর দাম গত এক বছরে অন্তত ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেতন বাড়ছে শ্রমিকদের, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জমি ভাড়া সব কিছুতেই খরচ বেড়েছে। অথচ বাজারে বিক্রি কমে যাওয়ায় ডেভেলপারদের লাভ তো দূরের কথা, নিজেদের মূলধনই টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হচ্ছে নির্মিত ইউনিটগুলো আগের দামে বা তার চেয়েও কমে বিক্রি করতে, শুধু ব্যালান্স শিট বাঁচানোর জন্য। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে বিশেষ করে নতুন বা মাঝারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো।
চাপ পড়বে সহায়ক শিল্পেও : আবাসন ও নির্মাণ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে ইট, সিমেন্ট, রড, সিরামিক, আসবাব, পাইপ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পেইন্টস, জানালা-দরজাসহ অন্তত ৫০টির বেশি সহায়ক শিল্প। এসব খাতে জড়িত প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ শ্রমিক, প্রকৌশলী, স্থপতি, কর্মী ও সরবরাহকারী। ডেভেলপাররা আশঙ্কা করছেন, বাজার এমন থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক ও অফিস কর্মী ছাঁটাই শুরু হবে। এ চাপ সরবরাহ চেইনজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, যা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
এনজাক ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মামুনুর রশিদ বলেন, নির্মাণসামগ্রী রড ও সিমেন্টের উচ্চমূল্যের কারণে কয়েক বছর ধরেই এ খাতের অবস্থা খারাপ। তবে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী টানা আন্দোলনের পর থেকেই আবাসন খাতের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আওয়ামীপন্থী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলারা এখন টাকা ধরে রেখেছে। কোথাও বিনিয়োগ করছে না। সাধারণ মানুষ, যারা ফ্ল্যাট কেনার চিন্তা করেছিল, তারাও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কেনার সাহস করছে না। অন্যদিকে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়ায় দেশে নতুন ফ্ল্যাটের কিছুটা সংকটও রয়েছে। যদিও এখন ফ্ল্যাটের চাহিদা না থাকার কারণে সেটি বোঝা যাচ্ছে না। যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে তখন ফ্ল্যাটের সংকটটি বোঝা যাবে।
কমেছে প্লট বা জমি বিক্রিও : ফ্ল্যাট বিক্রি ও বুকিংয়ের পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক ফাহাদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে সামগ্রিকভাবেই সব ধরনের ব্যবসায় এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। আবাসন বিনিয়োগের বড় একটি খাত। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের পরিবেশ তেমন না থাকায় মানুষের প্লট কেনায় মনোযোগ কম। আমরা ব্যবসা নিয়ে সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। আশা করছি, শিগগিরই দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে ব্যবসা। এদিকে, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম আগামী আগস্ট মাসে বাড়ির কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণে বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে রড ও সিমেন্ট পাওয়ার আশায় এক ডিলারকে অগ্রিম টাকা জমাও দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে আপাতত নতুন বাড়ির পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন তিনি।
এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ