আসছে বাজেট, খাদ্যে বরাদ্দ বাড়ছে ৯ গুণ

খাদ্যে বরাদ্দ বাড়ছে

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং খাদ্য মজুত ও বিতরণ ব্যবস্থা সুসংহত করতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ৯ গুণের বেশি বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা করা হতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্রটি জানিয়েছে, বর্তমান সরকার খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কোনো পরিস্থিতিতেই যাতে খাদ্যের সংকট তৈরি না হয়, সরকার সব সময় সে চেষ্টা চালাচ্ছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই আগামী অর্থবছরে খাদ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজাটে খাদ্য খাতের বরাদ্দ প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় অনেক বাড়ানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪.১০ শতাংশ, দেশের ইতিহাসে রেকর্ড

সূত্রটি আরও জানিয়েছে, অনেক দিন ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ কিছুটা চাপে রয়েছে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণে খাদ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য খাতে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১৯ কোটি টাকা। ফলে আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৯৮১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২৪ গুণ। অবশ্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে খাদ্য খাতের বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ৮ কোটি টাকা করা হয়েছিল। এ হিসাবেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে খাদ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন আয়ের মানুষ বেশ চাপে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এক মাস আগে অর্থাৎ মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে আগামী অর্থবছরে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। আগামী অর্থবছরের বাজেট দেওয়ার সময় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে খাদ্য সহায়তা ও টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এজন্য খাদ্য সহায়তা খাতে ভর্তুকি বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকা এবং টিসিবির ভর্তুকি বাবদ ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে খাদ্য ভর্তুকি খাতে ৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ও টিসিবির ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকার খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে। যে কারণে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে খাদ্য ক্রয় সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব এলে তা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয় মাথায় রেখেই এবার খাদ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এবার খাদ্য খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে খাদ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৯ কোটি টাকা। তার আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৫০২ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপাদান। বাজেটে খাদ্য খাতের বরাদ্দের বিষয়টি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্য মজুত ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এ কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এ খাতের বরাদ্দ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।

এদিকে নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে পারেন। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। ফলে স্বাধীনতার পর এই প্রথম, আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। আগামী ২ জুন বিকেল ৪টায় অর্থ উপদেষ্টার ধারণ করা বাজেট বক্তব্য বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হবে। বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় এবং জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় এবার সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে না।

নতুন অর্থবছরে মার্কিন শুল্কের চাপ সামলাতে ১৩৫ পণ্যে শুল্ক কমানো হতে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ৩১টি শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করার পাশাপাশি আয়করের আওতায় আনা হতে পারে আইটি ব্যবসাকে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জুলাই আন্দোলনের আহত সরকারি গেজেটভুক্ত জুলাইযোদ্ধাদের আয়করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতে পারে। বাড়ানো হতে পারে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি এবং মার্কিন প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্কের চাপ সামলাতে ১৩৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক এবং ৩ শতাধিক পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর আমদানি-রপ্তানিকারকদের স্বস্তি দিতে বাজেটে ভুল এইচএস কোড ঘোষণা বা মিথ্যা ঘোষণার জরিমানা কমানো হচ্ছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কখনো ভুলবশত বা অজ্ঞতাবশত এইচএস কোড ভুলের কারণে মিথ্যা ঘোষণা হয়।

গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা এইচএস কোডের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহল থেকে অভিযোগ করায় আগামী বাজেটে এটি মিথ্যা ঘোষণার সমপরিমাণ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। বর্তমানে মিথ্যা ঘোষণার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ জরিমানার বিধান আছে।

নতুন অর্থবছরের শুল্ক স্তর একটি বাড়িয়ে ৭টি (০%, ১%, ৩%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%) করা হতে পারে। মূলত দেশে উৎপাদন হয় না, এমন মধ্যবর্তী এবং শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের শুল্ক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, তুলাসহ শিল্পের কাঁচামালের শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। একইসঙ্গে সম্পূরক শুল্ক স্তর ১২টি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬ স্তরের (০%, ১%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%) শুল্ক কাঠামো বিদ্যমান।

বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। আইএমএফের পরামর্শে শিল্পের এই কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে আইটি ব্যবসা থেকে উদ্ভূত আয়কে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে মধ্যবিত্তের পাশাপাশি উচ্চবিত্তের ওপর কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এ জন্য করের স্লাবে পরিবর্তন আনা হতে পারে। বিদ্যমান কর কাঠামোয় একজন উচ্চবিত্তের আয় বছরে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিক্রম করলে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হতে পারে।

তবে নতুন অর্থবছরে সাধারণ ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জুলাইযোদ্ধাদের আয়কর সীমায় ছাড় দিতে পারে সরকার। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের আয়ের জন্য এই সীমা প্রযোজ্য হবে।

এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ