নিজস্ব প্রতিবেদক: এলডিসি থেকে বের হওয়া না হওয়া নিয়ে নানা বিতর্কের পর অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। জাতিসংঘ ঘোষিত সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নানা ধরনের যাচাই-বাছাই পেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সময় নির্ধারণ করেছে। সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৬ সালেই এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে আরো ২ থেকে ৫ বছর সময় প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। এ নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে দেশের মর্যাদা আরো বাড়বে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। তবে এ জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং উদ্যোক্তা উভয়কেই যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজস্ব খাত ঠিক করতে হবে এবং শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির বিষয়েও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা নেয়ার জন্য। তিনি বলেন, বেশ কিছু আমদানি নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি শুল্কমুক্ত সুবিধা যখন থাকবে না, তখন প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষত চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি বাড়বে। সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। এসব প্রস্তুতি না নিলে আমরা বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়ব।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় হওয়ার পর ব্যবসায়ী- উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এলডিসি থেকে উত্তরণ কমপক্ষে ১০ বছর পিছিয়ে দেয়ার কথা বলে আসছিলেন। তারা মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া চলমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয়া হলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে বলে মনে করা হয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণের পরও পরবর্তী তিন বছর ২০২৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলেও প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় রয়েছে। শুধু তাই নয়, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বহির্বিশ্বে বিশেষ কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ সহায়তা বেশি পাওয়া যাবে।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসবে। এ জন্য যেসব প্রস্তুতি দরকার, তা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের সমগোষ্ঠী কোনো দেশ এখন আর এলডিসিতে নাই। বাংলাদেশ ২০২১ সালেই এলডিসি থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের শিল্প খাতের চাপে আমরা এলডিসি উত্তরণের সময় বাড়িয়ে ২০২৬ সালে নিয়ে আসি। গ্রাজুয়েশনের অনেক ভালো দিক আছে। তিনি বলেন, দরিদ্র হয়ে থাকার মধ্যে কোনো সম্মান নেই। আমরা কেন মধ্য আয়ের দেশ হতে পারবো না। আমরা তো মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে আছি। কেন আমরা ট্যারিফের সুবিধার জন্য নিম্ন আয়ের দেশ হয়ে থাকবো।
এদিকে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। গতকাল সোমবার এক সেমিনারে তিনি বলেন, ট্রেড ডিপ্লোমেসি প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা চাচ্ছেন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দিতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাচ্ছি না পেছানো হোক। তিনি বলেন, আমরা ২৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন করলেও তিন বছর সময় পাব। এই তিন বছরে অর্থাৎ ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারবে। তৌহিদ হোসেন বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। আমি বিশ্বাস করি, তারা ওই সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য ইইউ কিছু শর্ত দিয়েছে। আমরা সেগুলো পরিপালন করব। কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ যে নেপালের চেয়েও পিছিয়ে, সে কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, আমরা লজ্জাজনক অবস্থায় আছি, এটা বাড়াতে হবে। এরসঙ্গে কিছু ছাড় থাকবে। এই ছেটো ছোটো ছাড়গুলো অর্থনীতিতে ভালো কিছু নিয়ে আসবে।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি আমরা এ বিষয়ে মতামত জানিয়েছি। এরপরেও সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলে ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে আমার কিছুই বলার নেই। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিরতা, শিল্পখাতে জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, উচ্চ সুদ হার ও বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহের স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে আমাদের বেসরকারিখাত প্রচন্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে ২-৩ বছর পিছিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
প্রায় একই মত প্রকাশ করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ীরা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়, তাই সরকারকের এ ব্যাপারে বেসরকারিখাতের সাথে আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর তিনি জোরারোপ করেন। আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, অবকাঠামো খাতে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি, এছাড়াও ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র অর্থনীতিতে। এলডিসি গ্রাজুয়েশন সম্পর্কে তিনি বলেন, যতক্ষ না পর্যন্ত দেশের আমদানির চাইতে রপ্তানি বেশি না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর জন্য প্রস্তুত নই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২৬ সালে গ্রাজুয়েশনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। এজন্য সময় বাড়ানো বা এটি আপাতত স্থগিত করার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যত পরামর্শই দিক না কেন জিএসপির নতুন স্কিমের সেইফ গার্ড ধারা সংশোধন না করলে জোটটির বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা হারাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। এ অবস্থায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে আরো ৫ বছর সময় চান তিনি। হাতেম বলেন, শুধু বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধন করলেই হবে না; ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন জিএসপি স্কিমের সেইফ গার্ড ধারা সংশোধন না করলে কোনো রকম বাণিজ্য সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বিগত সরকারের তথ্যের ওপর ভর করেই ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু কোনো পরিসংখ্যানই সঠিক ছিল না। অর্থনীতির বর্তমান চিত্র বলছে, এখন উত্তরণ করতে গেলে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে বাণিজ্য চালাতে হবে। এতে খরচ অনেক বাড়বে। আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বলেন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) কারণে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভিয়েতনাম ২০২৭ সাল থেকে শূন্য শুল্কে রপ্তানি করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হলে ১২ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হবে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এলডিসি উত্তরণের মেয়াদকাল তিন বছর পেছানো দরকার। তিনি বলেন, গত এক বছরে ১০০টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও ২০০ কারখানা বন্ধের পথে। বর্তমান সরকার জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য শ্রম আইন সংশোধনে আমেরিকার প্রেসক্রিপশনে কাজ করছে। অথচ আমেরিকা জিএসপি দিলেও সেখানে পোশাক ও বস্ত্র খাত কখনও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না।
বিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যবসায়ীরা এই মুহূর্তে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার এবং রাজনীতিবিদরা অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে ভুলে গেছেন। তারা অন্যান্য ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত। অথচ অর্থনীতির চাকা না ঘুরতে থাকলে ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করবে তারা অর্থনীতি সামাল দিতে পারবে না। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা ক্ষতিগ্রস্ত না করার উপায় বের করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। যাতে কর্মসংস্থান ধরে রাখা যায়, বিনিয়োগ বাড়ানো যায় এবং উৎপাদন খরচ সহনীয় পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না।