জুলাই বিপ্লবের পর গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত গাজীপুর ও ঢাকার সাভার-আশুলিয়া শিল্প এলাকায় স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় ৯৬টি কারখানা। তার মধ্যে গাজীপুরে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মোট ৫৬টি এবং সাভার-আশুলিয়ায় ৪০টি। এসব কারখানার ৬১ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী এখন বেকার।
পঞ্চগড় সদরের শারমিন আক্তার (২৭) কাজ করতেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায়, নায়াগ্রা টেক্সটাইলের প্রিন্টিং সেকশনে। অর্ডার সংকটের কারণে গত ১৪ নভেম্বর স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিমুখী কারখানাটি। বেকার হন শারমিনসহ চার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
চন্দ্রা এলাকায় ছাপরা ঘরের একটি কক্ষে ভাড়া থাকেন শারমিন আক্তার। ভাড়া বাসায় গেলে তিনি বলেন, ‘স্বামী একটি হোটেলে ধোয়ামোছার কাজ করেন। বেতন খুব সামান্য। মূলত আমার বেতনে চলত সংসার। চাকরি না থাকায় দোকানে বাকি, বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছি না। কয়েক মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়েছে। টাকার অভাবে একমাত্র মেয়ে মারিয়াকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
বন্ধ নায়াগ্রা কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে গেট বন্ধ। ভেতরে দুজন নিরাপত্তারক্ষী পাহারারত। একসময় যে কারখানা ছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মচঞ্চল্যে মুখর, সেখানে এখন সুনশান নীরবতা। মেশিনপত্রে যতটা না ধুলির স্তর জমেছে, তার চেয়ে বড় কষ্টের স্তর জমেছে শ্রমিকদের জীবনে—জানান চাকরি হারানো কয়েকজন।
ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার বুড়িরবাজার এলাকার বার্ডস গ্রুপ লিমিটেডে কাজ করতেন চার হাজার ২৭৪ জন শ্রমিক-কর্মচারী। বিজিএমইএভুক্ত রপ্তানিমুখী কারখানাটি গত ২৯ আগস্ট বন্ধ হয়ে যায়, বেকার হন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
ওই কারখানার নিটিং বিভাগের শ্রমিক সাহেদা বেগমের ভাড়া বাসায় গেলে তিনি জানান, স্বামী দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। তিন সন্তানের সবাই লেখাপড়া করে। গ্রামে থাকা বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকেও টাকা পাঠাতে হয়। সব কিছুই হতো তাঁর বেতনের টাকায়। বেকার হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, স্বামীর চিকিৎসা। তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ ২০টি বিজিএমইএভুক্ত। বাকিগুলোর বেশির ভাগই সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ পাওয়া ছোট কারখানা। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে ৩৩টি কাজ না থাকায়, ২১টি আর্থিক সংকট, একটি গ্যাসসংকট এবং অন্যটি স্থানান্তরের কারণে বন্ধ হয়। বেক্সিমকোর কারখানায়গুলোতে ২৮ হাজার ৫১৩ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। এ ছাড়া বন্ধ অন্য কারখানাগুলোতে কাজ করতেন ১৯ হাজার ৭১২ জন শ্রমিক-কর্মচারী। সব মিলিয়ে শুধু গাজীপুরেই বেকার হয়েছেন ৪৮ হাজার ২২৫ জন শ্রমিক।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) মোতালেব মিয়া জানান, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত গাজীপুরে ৫৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। তার মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপেরই ১৩টি, কেয়া গ্রুপের চারটি কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হলেও সেগুলো পুনরায় চালু হয়েছে। গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুরের আইরিশ নিট ও আইরিশ ফেব্রিক্স বেআইনিভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠান দুটিও চালু হয়েছে। এই দুই কারখানায় পাঁচ-ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করেন।
তিনি আরো জানান, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কারখানা বন্ধের সঠিক কারণ নির্ণয় এবং কারখানা চালু করতে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাংক ঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশির ভাগ কারখানা। কারখানা বন্ধ থাকায় স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িভাড়া সব ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, কাজের সন্ধানে শ্রমিকরা কারখানায় কারখানায় ঘুরছেন। কিন্তু কোথাও চাকরি মিলছে না। খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছেন তাঁরা। আশুলিয়ার ধনাইদ এলাকার জেনারেল নেক্সেট ফ্যাশনের চাকরি হারানো শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, কাটিং বিভাগে কাজ করতেন। মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খারাপ ছিলেন না। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনিসহ সাড়ে চার হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়েছেন।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে আরএমজি, নন-আরএমজি মিলিয়ে এক হাজার ৮৬৩টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পে মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে আন্দোলন, অর্থ সংকট ও কাজ না থাকায় গত ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪০টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে।