গরিব মানুষ থেকে শুরু করে উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি কেউই সেই সংস্কারের সুফল পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এখন যে সরকারকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দেখি, তার অভ্যন্তরেও আরেকটি শক্তিশালী ক্ষমতাকেন্দ্র কাজ করছে, যা আজ আর গোপন কোনও বিষয় নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আরেকটি সরকার সক্রিয় রয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এখন সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন, বিশেষ করে দলীয় নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী চেতনায় সরকার গঠনের পরও তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারে প্রতিফলিত হয়নি। গরিব মানুষ থেকে শুরু করে উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণিÑ কেউই সেই সংস্কারের সুফল পায়নি। এখন সরকারের নিরপেক্ষতা পুনঃপ্রমাণ করা…কাদম্বরীকেই করিতে হইবে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বুধবার আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন। বৈঠকে আলোচনার বিষয় ছিল ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। বৈঠকের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক জানানো হয়। সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।
আরও পড়ুনঃ অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। এতে অংশ নিয়েছেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের গবেষণা বিশেষজ্ঞ সহুল আহমদ প্রমুখ ।
বৈঠকে দেবপ্রিয় বলেন, বৈষম্যবিরোধী চেতনায় সরকার গঠনের পরও তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সংস্কারে প্রতিফলিত হয়নি। গরিব মানুষ থেকে শুরু করে উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণিÑ কেউই সেই সংস্কারের সুফল পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, এই সরকার অনন্তকালীন নয়। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং সেটির একটি ‘ডেস্ক ক্লিয়ারিং’ লিস্ট থাকা উচিত। প্রধান উপদেষ্টাকে এখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে স্পষ্ট করতে হবেÑ তিনি কী কী সংস্কার সম্পন্ন করেছেন এবং কোন কাজগুলো অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকার কি একটি প্রকৃত, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম? আপস বা আঁতাতের নির্বাচন নয়, একটি বাস্তব নির্বাচন যেখানে জনগণ শুধু ভোট দেবে না, ভোটের পরদিনও নিরাপদে থাকবে— এই নিশ্চয়তা কি দেয়া যাবে? তিনি আরো বলেন, এখনকার প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর সক্রিয় ও বড় পরিসরে অংশগ্রহণ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়ন কঠিন। অস্ত্র উদ্ধার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নির্বাচনী পরিবেশ গঠনে সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, শেখ হাসিনার মতো স্বৈরচারী সরকার আসবে না। একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর হবে। এই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াতেই মার খেয়ে গেলাম। আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা লিঙ্গের নামে বৈষম্যবাদী রাজনীতি ও দর্শন যারা ধারণ করে, তাদের দাপট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারাই এই অভ্যুত্থান করেছে। অভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, নারীকে আক্রমণকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দাপট বেশি। আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ ছিল জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, গত এক বছরে এ মানুষগুলোকে বারবার রাস্তায় নামতে হয়েছে। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে। সেটা তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ। যদিও গঠনের মধ্যে সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে শুধু সংবিধান ছাড়া আর কোনো প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মনোযোগ নেই। এই সরকারের বেশি মনোযোগ এমন চুক্তি করা, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। কোনো আলোচনা ছাড়া স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তা বলেছেন, এ সরকার অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যার উদাহরণ একমাত্র স্টারলিংক ছাড়া আর কেউ দেখেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, জনগণের নামেই সবকিছু হচ্ছে, তাদের কথা বলেই সবকিছু হচ্ছে, কিন্তু জনগণকে আমরা গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছি। এখানে খুবই পরিষ্কার, জনগণ আর কোনো বিষয় নয়, দেশ কোন দিকে যাবে, কীভাবে পরিচালনা হবে, জনগণ কোনো বিষয় নয়। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেখতে পাচ্ছি একধরনের বাংকার মেন্টালিটি আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বাংকার মেন্টালিটি হয় তখন, যখন সবকিছু একটা নির্দিষ্ট লেন্স দিয়ে শুধু দেখা হয়, মানুষকে সহযোগী হিসেবে না দেখে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে নিয়েই চেষ্টা করা হয়। এখানে একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, পতিত সরকারের অনুশোচনাহীন সমর্থক গোষ্ঠীর দেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখী প্রচেষ্টা একটা বিরাট বিপদ হিসেবে সমাজের মধ্যে আছে বটে। কিন্তু বাংকার মেন্টালিটি দিয়ে এটা কোনো দিনও সমাধান করা যাবে না।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও কাগুজে ঐকমত্য প্রক্রিয়া মুখোমুখি অবস্থানে আছে। জাতীয় ঐক্য আসলে পেছনে পড়ে গেছে। জাতীয় ঐক্যের প্রতি মনোযোগ নেই। এই কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়াটা জুলাই-আগস্টের জাতীয় ঐক্যের শক্তিটাকে আমরা পেছনে ফেলে দিয়েছি। কেতাবি যোগ্যতার একটা প্রচণ্ড সমাহার হয়েছে এবং একই সময়ে সক্ষমতার বিশাল ধস নেমেছে। কেতাবি যোগ্যতার সমাহার, একটা নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ আর প্রকৃত সক্ষমতার ধস- এখানে আমরা একটা বড় ধরনের বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ, নেগোসিয়েশন প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা সক্ষমতার ধস দেখছি। কিন্তু ওই কেতাবি যোগ্যতার খুবই সরব ও খুবই প্রবল উপস্থিতি আছে। সেই অর্থে জনগণ গণনার বাইরে চলে গেছে। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। যে মানুষ পরিবর্তন এনেছিল, যাদের অংশগ্রহণে পরিবর্তন এসেছিল, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই গুটিয়ে নেয়াটা একটা সিগনাল। তারা দেখেছে, তাদের আশা-আকাঙ্খা ছিল, তারা দেখছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও কথার ফুলঝুরির মারপ্যাঁচে আসলে চলছে অন্য ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী কিছু নিয়ে সমালোচনা করলে তকমাবাজি করা হচ্ছে বলেছেন উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে দ্বিমত করলে, এনসিপি নিয়ে কিছু বললে অভ্যুত্থানের পক্ষে যারা ছিল তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। মাহা মির্জা বলেন, কষ্ট হচ্ছে যে অভ্যুত্থানের পর কার্পেটের তলে রেখে কথা বলার কথা ছিল না। কী বললে কী ট্যাগিং খাব, এসব হওয়ায় কথা ছিল না। আওয়ামী লীগের সময়েও সাহস করে অনেক কিছু বলেছি, কিন্তু এখন আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে, লিখব কিনা। লেখার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণ হচ্ছে। মাহা মির্জা আরো বলেন, ট্যাগিংয়ের শিকার আমরা কমবেশি সবাই হচ্ছি। যারা একটু লিবারেল, মডার্ন আধুনিক জীবনযাপন করলে, ছায়ানটে গেলে, রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে সবাই আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের দোসর। এদের ব্যাশিং করতে হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রান্তিক পর্যায়ে যাঁরা কাজ করেন সরকারের হয়ে তাদের আওয়ামী ট্যাগিং দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলেন মাহা মির্জা। এ ট্যাগিং আলার্মিং বিষয় বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের বিচারব্যবস্থার ভেতরে ভয় এখনো কাটেনি। সারা হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এখন কোনো ভয়ভীতি নেই, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। ভয় বিচারব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। বিচারপতিদের সবারই চিন্তা হচ্ছে, আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কোনো একটা গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কিছু একটা নিয়ে জোরে আওয়াজ তুললেই তো শেষ। সে বিচারপতির আর কোনো ভবিষ্যৎই থাকবে না। এমন ভয়ের পরিবেশে কে ঠিকমতো রায় দেবে বলুন? রায় তো দূরের কথা, আদেশইÑ বা কে দেবে?’ সারা হোসেন বলেন, গত এক বছরে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা হলেও এর কাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। প্রাথমিকভাবে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো ঠিক ছিল কি না, সেসব নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। হাইকোর্টের বিচারকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে কেন? সেসব কারণ আমরা আজও জানি না। এগুলো নিয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পত্রিকাগুলোও বেশি কিছু লেখার চেষ্টা করছে না।
জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে সারা দেশে গণহারে করা ঢালাও মামলার বিষয়ে সারা হোসেন বলেন, মামলায় লাখ লাখ নাম দেয়া হয়েছে। সেগুলো ঠিক কি না, সেটা স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ঢালাও মামলা সাংঘাতিক লজ্জার ব্যাপার। সরকার এ ব্যাপারে গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সরকারকে বললে বলে আমরা তো মামলা করিনি, জনগণ করেছে। কিন্তু সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তো কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেন না, এটা ঠিক হয়নি। নিরপরাধ যাঁরা ১০ মাস ধরে জেলে আটক আছেন, তাঁদের ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার দায় কিন্তু তাদেরই। আটক ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিচার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, জামিনের আদেশ নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে জুলাই-আগস্টের কোনো মামলাতেই কোনো জামিন হবে না। এই যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় সরাসরি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের না হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতি এবং গাফিলতি রয়েছে। ক্ষমতাধররা মনে করেন আপনার যে-ই অধিকার আছে, তা আপনার প্রতিপক্ষের নেই। এমন ভাবনার জায়গা থেকে সরে আসতে হবে।
এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ