বিভিন্ন আইটেমের জন্মদিনের কেক বানাতে ফেসবুকে মিনার নাহার পপি বেশ পরিচিত মুখ। সংসার, সন্তান সামাল দেয়ার পাশাপাশি কিছু বাড়তি স্বচ্ছলতার জন্য তার এ ব্যবসা শুরু। করোনা কালে ঘরে বসেই সিজের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে তিনি প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে হোমমেইড খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। ফেসবুক পেইজে তার পেইজের নাম সালেহা কিচেন। বিভিন্ন আইটেমের পিঠা, পায়েস, হরেক রকমের মজাদার রান্না, আর বাচ্চাদের মজার মজার কেক বানিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করেন তিনি। কিন্তু গত কয়েকদিনের ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সে ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। পপি বলেন, হঠাৎ করেই নেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একেবারেই অর্ডার বন্ধ। প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকার অর্ডার হলেও এখন একেবারেই শূণ্য। এছাড়া আমার দুইটা অর্ডার পেইন্ডিং হয়ে আছে। এভাে চলতে থাকলে ব্যবসা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।
ব্রডব্যান্ড এবং মোবাইলে ফেরজি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় মিনার নাহার পপির মতো অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। এতে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশীয় ই-কমার্স খাত। সঠিক হিসাব না থাকলেও খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা দৈনিক অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এ খাতে। ইন্টারনেট না থাকায় গ্রাহকরা যেমন পণ্য বা সেবা অর্ডার করতে পারছেন না, তেমনি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না ই কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর। অর্ডার না থাকলেও পরিচালন ব্যয়, ফিক্সড কস্ট, এ্যাসেট লায়াবিলিটির মতো খরচের বোঝা ঠিকই রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-কমার্স খাতে এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
বিশ^ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আামাদের দেশে কর্মসংস্থানের একটি নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রচুর শিক্ষিত তরুনরা কাজ করছে। অর্থাৎ ফ্রিল্যান্সিংএ বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় ১৬ শতাংশ মানুষ এ ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং পেশায় যুক্ত। এখানে একটি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রাহকের মনে আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে। সুতরাং অর্থনীতিতে কি পরিমান ক্ষতি হলো তা টাকার অংকে পরিমাপ করা কঠিন বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
টানা ছয়দিন ইন্টারনেটবিহীন অবস্থায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌছেছে। ইন্টারনেট না থাকায় বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের প্রিপেইড মিটারের বিল দেয়া যাচ্ছে না। এটিএম বুথ থেকে তোলা যাচ্ছে না টাকা। বিদেশে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আইসিটি, আউটসোর্সিং, ই-কমার্সের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসার। দেশজুড়ে গত বুধবার থেকে ফোর-জি মোবাইল ইন্টারনেট এবং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের উপর ভর করে জনজীবন এবং নাগরিক সেবার প্রায় সবটুকুই ইন্টারনেটভিত্তিক হওয়ায় ‘ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের’ এই সময়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। দেশের শীর্ষ ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার খন্দকার তাসফিন আলম বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দারাজসহ পুরো ই-কমার্সই ‘কমিপ্লট শাটডাউন’ অবস্থা। যেহেতু ইন্টারনেট নেই, তাই গ্রাহকরা অর্ডার করতে পারছেন না। আবার ইন্টারনেট বন্ধের আগ মুহুর্তে যেসব অর্ডার জমা পড়েছিল, সেগুলো প্রক্রিয়া করতে পারছি না। কারণ দারাজের কার্যক্রম পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়। রাইডারসহ সব কর্মীর নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময়েও এমন অবস্থা হয়নি, কারণ তখন ইন্টারনেট ছিল। অথচ এখন জিরো অর্ডার চলছে। সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকেই এজন্য ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।
বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন উল্লেখ করে তাসফিন আরো বলেন, দারাজে বিক্রিত পণ্যগুলোর ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। বিদ্যমান অবস্থায় তারা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দারাজের হয়তো বিনিয়োগকারীদের তহবিল আছে; যা দিয়ে কিছুদিন চলা যাবে। কিন্তু তাদের তো তেমন তহবিল নেই। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা ইকরা বুকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের মতো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই সঙ্কটের মধ্যে রয়েছ। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাহকরা পন্য অর্ডার করতে পারেছন না, অঅবার আমরাও পণ্য ডেলিভারি করতে পারছি না। এতে আমাদের দৈনিক লেনদেন শূণ্যের কোঠায়। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কর্মীদের বেতন দিতে হবে। অফিস বা যানবাহন ভাড়া দিতে হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কোন ধরনের নির্দেশনা না দিয়েই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া। সিরাজুল ইসলাম বলেন, অনেক উদ্যোক্তাই ফেসবুকে প্রমোশনের জন্য ‘মার্কেটিং কস্ট’ ফিক্সড করে দেয়। হঠাৎ ফেসবুক বন্ধ হলেও প্রমোশন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকেরই ব্যবসা হোক বা না হোক ‘ফেসবুক ফিক্সড কস্ট’ গুণতে হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য জনপ্রিয় ই-কমার্স প্লাটফর্ম চালডাল ডটকমের প্রধান নির্বাহী জিয়া আশরাফ বলেন, গ্রাহকরা যেমন অর্ডার করতে পারছেন না, তেমনি আমরাও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। দৈনিক ৭০-৮০ লাখ টাকার অর্ডার হয় চালডালে। সেই অর্ডার একেবারেই শূণ্য। তবে কর্মীদের বেতন ওয়্যারহাউসের ভাড়া- এ ধরনের পরিচালন ব্যয় থেমে নেই। অনেক সম্পত্তির বিপরীতে ব্যাংকের দেনা থাকলে সেগুলো থেমে নেই।
আরেক ইকমার্স প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফুটওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা আমিন উদ্দিন বলেন, আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমাদের পুরো ব্যবসা টিকে থাকে বিক্রির ওপর। এই চারদিনে কোন বিক্রি নেই। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে বুঝতে পারছি না। অথচ মাস শেষ হলেই অফিস ভাড়া, কর্মীদের বেতন দিতে হবে। বিক্রির জন্য ফেসবুকে যে বুস্ট করেছিলাম, সেখানেও ক্ষতি।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ইকমার্স খাতে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখ করে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের ফিন্যান্সিয়াল সেক্রেটারি আসিফ আহনাফ বলেন, ইকমার্সে দৈনিক ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সে লেনদেন একেবারেই বন্ধ। তার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে পরিচালন ব্যয়, ফিক্সড কস্ট, অ্যাসেট লায়াবিলিটির মতো খরচের বোঝা ঠিকই যুক্ত হচ্ছে। এতে দৈনিক ক্ষতি ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ইকমার্স খাতের পরিচালন ব্যায়ের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ই-কমার্স ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কর্মীদের বেতন দিতে হয়। অফিস বা যানবাহন ভাড়া থাকে। ব্যবসা হোক বা না হোক সেই ব্যয় প্রতিষ্ঠানকে করতেই হয়। কারও বিনিয়োগকারী থেকে ফান্ডিং নেয়া থাকে কারো ব্যাংক ঋণ থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের সুদ বা বিনিয়োগকারীর চাহিদা মেটাতে হয় উদ্যোক্তাকেই। ই-কমার্স এখন দিনে ৮ লাখ পণ্য ডেলিভারি হয়। প্রায় ৫০ হাজার ডেলিভারি নির্বাহী এসব পণ্য গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। তাদের জীবন জীবিকা থেমে আছে। সবকিছু হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে।