চার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের স্মারকলিপি

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চরম অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছে এই পরিষদ।

বৃহস্পতিবার (২২ মে) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান পরিষদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। তারা প্রধান উপদেষ্টার এপিএস সাব্বির আহমেদের কাছে স্মারকলিপিটি হস্তান্তর করেন।

ঐক্য পরিষদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কর পরিদর্শক মুতাসিম বিল্লাহ, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শফিউল বসর, উপ-কর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম কুশল, অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা এবং অতিরিক্ত কমিশনার (কাস্টমস) হাছান মুহম্মদ তারেক।

স্মারকলিপিতে উত্থাপিত মূল দাবিগুলো হলো-

১. জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল।
২. বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ।
৩. রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ।
৪. সব অংশীজনের মতামত নিয়ে টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করা।

স্মারকলিপিতে তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে তারা আশা করেন, দেশ, জনগণ ও অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম, বাস্তব জ্ঞাননির্ভর, দক্ষ ও কার্যকর একটি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সদ্য জারিকৃত অধ্যাদেশটি বাতিলসহ তাদের দাবিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি করার অধ্যাদেশ বাতিল করা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন ও কলমবিরতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।

গত মঙ্গলবার এ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআরের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। যদিও ওইদিন রাতেই তারা জানান, বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়নি। পরের দিন বুধবার এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা, নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির ব্যাপকতা ও যৌক্তিকতার বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঠিক তথ্য না দিয়ে আড়াল করার অভিযোগ আনা হয়।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এনবিআর চেয়ারম্যানের চরম অসহযোগিতা এবং যোগাযোগের অপর্যাপ্ততার কারণে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষা কিংবা আশঙ্কার কোনো কথাই অর্থ উপদেষ্টাকে জানাতে পারিনি। এনবিআরের সব কর্মকর্তার মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে অনির্বাচিত দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিবৃন্দ অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে, রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের পরিপন্থী একটি মডেল সমর্থন করেন।

এতে বলা হয়, সেখানে রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগের মর্যাদায় “রাজস্ব কমিশন” নামে একটি স্বাধীন সংস্থা ও পুনর্গঠিত “জাতীয় রাজস্ব বোর্ড”-এর পরিবর্তে “রাজস্ব নীতি” এবং “রাজস্ব ব্যবস্থাপনা” পৃথকীকরণের মাধ্যমে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে রাজস্ব সংস্কার পরামর্শ কমিটির প্রতিবেদনে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত ও প্রভাবশালী একটি মহলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে খসড়াটির নেতৃত্ব সংক্রান্ত ধারায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। এতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী বিধানও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার জন্য বারবার চেয়ারম্যান এবং দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিবকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ করে দেননি।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, দেশের উন্নয়নের অক্সিজেন রাজস্ব আহরণের প্রাণভোমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশটি অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে জারি করা হয়েছে।

এতে অভিযোগ করা হয়, ওই অধ্যাদেশে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাংগঠনিক স্বাতন্ত্র্য ও পেশাগত স্বকীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল কাঠামো বিনষ্ট করে রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কার্যক্রমটি বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজস্ব সংস্কারের আলোকিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশান্বিত হয়েছিলাম, ঠিক তখনই আমরা জানতে পারলাম রাজস্ব সংস্কার কমিটির সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে সবার অগোচরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আরেকটি খসড়া প্রস্তাব প্রস্তুত হয়েছে। যেই প্রস্তাবের মাধ্যমে কর, কাস্টমস এবং ভ্যাট কর্মকর্তাদের কর্মক্ষেত্র খর্ব হয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে একতরফাভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। এই শঙ্কা থেকে তারা তাৎক্ষণিকভাবে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন এবং এই অধ্যাদেশ জারি হলে দেশের অর্থনীতির জন্য তার ভয়াবহ পরিণতির কথা জানান।

এতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক উন্নত চর্চা অনুযায়ী, একটি দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতপূর্বক স্বতন্ত্র সংস্থা, বোর্ড বা এজেন্সি করা প্রয়োজন, যাতে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের আওতামুক্ত থাকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ থেকেও রাজস্ব কাজে অভিজ্ঞ কাউকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার প্রধান করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়েছে এবং কর জিডিপি বাড়বে এমন কোনো উদ্যোগের প্রতিফলন অধ্যাদেশে নেই বলেও জানানো হয়েছে।

গত ১৩ মে আগারগাঁওয়ে এনবিআরের সামনে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলম বিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯ মে কলম বিরতি কর্মসূচি পালিত হয়। আলোচনার আশ্বাসে ২০ মে আন্দোলন স্থগিত রেখে ২১ মে থেকে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসে।