ছাদ থেকে নীহারিকার ছবি তুলে আলোচনায় ঢাকার ছেলে জুবায়ের

ওরিয়ন নেবুলা বা কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলে আলোড়ন ফেলেছেন জুবায়ের কেওলিন। ঢাকায় বাসার ছাদ থেকেই তিনি ছবিগুলো তোলেন। সম্প্রতি ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করার পর তা রাতারাতি ভাইরাল হয়। সেসব ছবিতে নীহারিকার উজ্জ্বল তারকারাজি, ধূলিমেঘ ও গ্যাসীয় ধূলিকণাসহ মহাকাশের আশ্চর্যজনক গঠন উঠে এসেছে।

জুবায়ের কেওলিন নিজেকে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচয় দেন। নীহারিকার ছবি তিনি যে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তুলেছেন তা তার তৈরি করি। জুবায়ের দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশের ছবি তুলে আসছেন। নীহারিকা ছাড়াও মহাবিশ্বের অন্যান্য উপাদানের প্রতিও তার আগ্রহ বেশ।

সম্প্রতি যে ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেগুলো তিনি এক দিনে তুলেছেন এমন নয়। এর কিছু এ বছর; আর কিছু গত বছর তুলেছেন। নীহারিকা ছাড়াও ভাইরাল হয়েছে চাঁদের ছবিও। সেটিও তুলেছেন তার বানানো টেলিস্কোপ দিয়েই। এ ছাড়া আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, জুপিটার বা বৃহস্পতির টাইম-ল্যাপস, যেখানে জুপিটার ঘুরছে। মঙ্গলগ্রহ ও শুক্রগ্রহের ফেজ পরিবর্তনের দৃশ্য এবং সূর্যের ছবি। সূর্যের ছবিটি তোলা হয় গত মে মাসে। তখন সূর্যে বিশাল চুম্বকীয় ঝড় হয়েছিল। ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলে।

বিজ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও এ বিষয়ে জুবায়েরের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এমনকি মাধ্যমিকেও তিনি বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেননি। এ বিষয়ে জুবায়ের বলেন, ‘আমি বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়েছি। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। স্কুলের পাঠও মুখস্থ করতে কষ্ট হতো। এসব কারণে মাধ্যমিকেও বিজ্ঞান পড়তে পারেনি। এসএসসিতেও ভালো গ্রেড পাইনি। তাই আমি কোনো ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। পরে একজনের পরামর্শে জিইডি সম্পন্ন করি। একই সাথে আমি অ্যানিমেশনে আমার ক্যারিয়ার শুরু করি। আমার এটির প্রতি আবেগ ছিল এবং এটিতে পারদর্শী হয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছি এবং এই শিল্পের প্রচারের জন্য চেষ্টা করি। এসব যা করেছি তা সবই আমার ২২ বছর বয়সের আগে ঘটেছিল। পরে ২০১০ সালে অগ্নিরথ স্টুডিওস নামে নিজস্ব থ্রিডি অ্যানিমেশন এবং ভিএফএক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করি।’

কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়-আশয়ে তার জানাশোনা কী করে? এমন প্রশ্নে জুবায়ের বলেন, আমি স্ব-শিক্ষিত। যা জানি তা অবশ্যই ইন্টারনেট এবং বইয়ের সাহায্যে শিখেছি। আমি কখনই বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর একাডেমিক পড়াশোনা করিনি।’ গ্রেড ও ক্রেডিটের চিন্তা বাদ দিয়ে শেখার অভ্যাসই তাকে এ পর্যায়ে এনেছে বলে দাবি জুবায়েরের।

সৌরজগৎ নিয়ে তার কৌতূহল সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল। স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, প্রথম টেলিস্কোপটি বানিয়েছিলেন চশমার কাচ দিয়ে। ওইটা দিয়ে প্রথম শত শত তারা দেখে আশ্চর্য হন তিনি। ওই সময় থেকে একটা পরিকল্পনা করেন; বড় হয়ে ভালো একটা টেলিস্কোপ বানাবেন। পরে যখন সক্ষমতা এলো তখনই তা বানাতে লেগে পড়েন।

তিনি জানান, টেলিস্কোপ বানানোর প্রথম পর্যায়ে মহাকাশের সুন্দর সুন্দর ছবি তোলেন, এমন কিছু আলোকচিত্রীর কাজ দেখতে থাকেন। সে সঙ্গে চলতে থাকে গবেষণা। প্রথম দিকে স্পেস টেলিস্কোপ ও ফটোগ্রাফিক টেলিস্কোপের কাজ নিয়ে তিনি তেমন কিছুই জানতেন না। কিন্তু লেগে থাকলেন জুবায়ের। ফলে ব্যাপক গবেষণা শেষে নিজেই বানিয়ে ফেললেন নীহারিকার ছবি তোলার মতো সক্ষম একটি টেলিস্কোপ। এ ক্ষেত্রে ঘরে বসে মহাকাশের ছবি তোলার বিষয়টি প্রাধান্য দেন তিনি।

এ ফটোগ্রাফারের অন্যতম সাফল্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৫০ আলোকবর্ষ দূরের কালপুরুষ নীহারিকার ছবি ধারণ করা। এটিকে বলা হয় নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর। কারণ মহাকাশের এ অঞ্চলে নিয়মিত জন্ম নেয় নতুন নতুন নক্ষত্র। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অন্যতম আগ্রহের জায়গা এটি। অপেশাদার হয়েও সেই নীহারিকার স্পষ্ট ছবি তাকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

তবে কাজটি ততটা সহজ ছিল না। অবশ্য মহাকাশের কোনো বস্তুর ছবি তোলাই জুবায়েরের জন্য সহজ কাজ নয়। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি তোলার ক্ষেত্রে এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হলো ঢাকার আলো ও বায়ু দূষণ। ঢাকায় আমার বাসার ছাদ থেকে বেশিরভাগ ছবি তুলি। শহরের আলো এবং খারাপ বাতাসের গুণমান সত্যিই ভালো ছবি তোলার সক্ষমতাকে বাধা দেয়। এমনকি কোনো রাত পরিষ্কার মনে হলেও সে দিনের দৃশ্যমানতাও ভয়ানক।

ভাইরাল হয়েই থেমে থাকতে চান না জুবায়ের। তিনি চান, আরও বড় এবং ভালো মানের যন্ত্র তৈরি করতে। এ জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জুবায়ের। আর এ কাজটিও বেশ উপভোগ করেন তিনি। এতে রসদ জোগায়- তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা এবং তার মন যা চায় সে পথে কাজ করা।

জুবায়ের বলেন, ‘আমাদের সুন্দর মহাবিশ্বের আরও ভালো ছবি তুলতে এবং সেই সৌন্দর্য সবার সাথে শেয়ার করতে চাই। এ জন্য কাজ করে যাচ্ছি৷ জ্যোতির্বিদ্যা এবং এর সাথে জড়িত প্রযুক্তির অগ্রগতিতে অবদান রাখতে চাই। বাংলাদেশ এবং এর বাইরে এই নতুন উদীয়মান সম্প্রদায়ের সাথে আমার জ্ঞান ভাগ করে নিতে চাই। আমার লক্ষ্য হচ্ছে, অন্যদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলা। আমার কাজের মাধ্যমে একটি শিশুকেও যদি কৌতূহলী হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি, যে বড় হয়ে হয়তো অন্য গ্রহে পা রাখবে।’