শুক্রবার প্রকাশিত জাপানের মুদ্রাস্ফীতির তথ্যে দেখা গেছে, গত মাসে দেশটিতে চালের দাম এক বছর আগের তুলনায় ৯৮ শতাংশ বেশি ছিল।
জাপানের সংস্কৃতিতে চাল বহু শতাব্দী ধরে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসেবে প্রচলিত আছে। চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাপানের সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, চালের এই দাম বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সরবরাহে ঘাটতি। এ ঘাটতির পেছনে বেশ কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো- ২০২৩ সালে নজিরবিহীন তাপদাহ চালের উৎপাদন ব্যাহত করে। ২০২৪ সালে ভূমিকম্পের সতর্কতা জারি হওয়ার পর চালের ঘাটতির আশঙ্কায় মানুষ বেশি পরিমাণ চাল মজুদ করার চেষ্টা করেন। এর ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়।
এদিকে রেকর্ডসংখ্যক বিদেশি পর্যটকের আগমনের ফলে সুশি ও চাল-নির্ভর খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। কিছু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চাল মজুদ করে কারসাজির অভিযোগ উঠে। এছাড়া দেশটিতে দিন দিন ধান চাষের জমি কমে যাচ্ছে।
দিন দিন জাপানিদের মধ্যে ভাত খাওয়ার অভ্যাস ক্রমশ কমতে থাকায় সরকার ধানের চাষ কমিয়ে অন্যান্য ফসল চাষে উৎসাহ দিয়ে আসছিল। এছাড়া দেশটিতে চাষীদের গড় বয়স অনেক বেশি এবং তাদের সন্তানরা আর কৃষিকাজে তেমন আগ্রহী হচ্ছেন না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ কৃষি খামার পরিচালনা করেন ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরা এবং ৭০ শতাংশ কৃষকের কোনো উত্তরসূরি নেই।
১৯৬১ সালের জরিপে ধানচাষ করা জমি ছিল প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ হেক্টর। ২০২৪ সালে তা কমে ২৩ লাখ হেক্টরেও দাঁড়িয়েছে।
টোকিও’র ৯০ বছরের পুরনো একটি চালের আড়তের তৃতীয় প্রজন্মের মালিক তাদাও কোইকে বলেন, সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে চালের উৎপাদনের পরিমাণ কমানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে, কিন্তু চালের ব্যবহার কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করেনি।
এখন আমরা এর পরিণতি ভোগ করছি।
সরকার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের জরুরি প্রয়োজনের জন্য মজুত করা চালের কিছু অংশ নিলামে তুলেছে। অতীতে এসব চাল শুধু দুর্যোগের সময় ব্যবহার করা হতো। ১৯৯৫ সালে এ মজুতাগার তৈরি হওয়ার পর এই প্রথমবার সরবরাহ সংকট সরকারকে জরুরি মজুত চাল বাজারে ছাড়তে বাধ্য করেছে।
উতসুনোমিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাসায়ুকি ওগাওয়া বলেন, সরকার যে মজুত করা চাল বাজারে ছেড়েছে, সেটা সাধারণ মানের মিশ্র চাল। সেগুলো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডেড বা ভালো চালের ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না।
দীর্ঘ সময় ধরে জাপানে মূল্যস্ফীতির হার স্থির বা নিম্নমুখী ছিল। কিন্তু এখন তা বাড়তে থাকায় ভোক্তারা চাপের মুখে পড়ছেন এবং সরকারের জনসমর্থন ক্রমশ কমছে।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গত বছর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়।
সম্প্রতি জাপানের কৃষিমন্ত্রীর এক মন্তব্যে নতুন করে জনরোষ তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী তাকু ইতো বলেন, ‘সমর্থকরাই আমাকে বিপুল পরিমাণ চাল উপহার দেন, আমার কখনও নিজের চাল কেনা লাগেনি।’ এ মন্তব্যের জেরে পরে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
জুলাইয়ে দেশটির উচ্চকক্ষ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ঘটনা এলডিপি’র জন্য আরও চাপ তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসে’র বিশ্লেষক মার্সেল থিলিয়ান্ট বলছেন, চলতি সপ্তাহে চালের দামে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত মিলছে। শিগগিরই চালের দাম স্বাভাবিক হতে পারে।
জাপানে চালের সংকট এখন শুধু একটি কৃষি বা অর্থনৈতিক ইস্যু নয়, বরং তা জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, বাজারনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেও দেখা দিয়েছে।