৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা গা ঢাকা দেন। যে যার মতো নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহকে বুধবার রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু কোন মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে গ্রেফতারের পর অসুস্থতা বোধ করায় কাজী জাফরউল্লাহকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্পদ ও টাকার কুমির ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম আসে কাজী পরিবারের। এর মধ্যে রয়েছেন কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ এবং ছেলে কাজী রায়হান জাফরের নাম।
ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) সংসদীয় আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ।
এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ডের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কাজী জাফর উল্লাহ ২০১৮ সালের হলফনামায় তার পেশা শিল্পপতি উল্লেখ করলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় পেশা বদলে রাজনীতিক বলে উল্লেখ করেন।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও কাজী জাফর উল্লাহ ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্ধন্দ্ধিতা করে হেরে যান। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী জাফর উল্লাহর স্ত্রী নিলুফা জাফর উল্লাহ।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী কাজী জাফর উল্লাহর সম্পদের পরিমাণ ৬২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৯ এবং নিট সম্পদের পরিমাণ ৬১ কোটি ৩৪ হাজার ৫১৭ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে তার নিজের ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৮ এবং স্ত্রীর ৬ লাখ ৭ হাজার ২২৭ টাকা দেখানো হয়েছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা অর্থের পরিমাণ ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ এবং স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা।
এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে কাজী জাফর উল্লাহর নামে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৮২ হাজার ৬৭০ এবং তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৬০ টাকার।
জাফরউল্লাহর নামে পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৭৫ লাখ টাকা (সঞ্চয়পত্র), ৫৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ টাকা (এফডিআর) এবং তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার জাফর উল্লাহর নামে রয়েছে ১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার ১১৮ টাকার (এফডিআর) এবং ৭৫ লাখ টাকার (সঞ্চয়পত্র)।
এ ছাড়া কাজী জাফরউল্লাহর আরএমএমএল শেয়ার মানি রয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নামে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ ও স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা জমা রয়েছে। তার নিজের ১০ লাখ ৮১ হাজার ৫১১ টাকা মূল্যের এবং স্ত্রীর নামে ৫৮ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি রয়েছে। সোনা ও অন্যান্য অলংকার রয়েছে কাজী জাফর উল্লাহর নামে ২ লাখ এবং স্ত্রীর নামে ৭ লাখ ৩১ হাজার টাকার। এ ছাড়া ৮ লাখ ৯৯ হাজার ২১২ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী, স্বামী-স্ত্রী দুজনের মিলিয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার আসবাব এবং যথাক্রমে ৪৫ হাজার ৮০ টাকা ও ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৪ টাকা মূল্যমানের আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এর বাইরে কাজী জাফর উল্লাহর টাকার পরিমাণ ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৮ এবং তার স্ত্রীর টাকা দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৭ হাজার ২২৭ টাকা।
স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে কাজী জাফর উল্লাহর নিজের নামে ফরিদপুরের শ্রীপুরে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৫৭ টাকা মূল্যের এবং তার স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮৯ টাকা মূল্যের অকৃষি জমির তথ্য উল্লেখ রয়েছে হলফনামায়। এ ছাড়া নিজের নামে ঢাকার ধানমন্ডিতে ১ লাখ ৭০ হাজার ও মিরপুরে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৮ টাকা মূল্যের দালান এবং তার স্ত্রীর নামে ঢাকার বনানীতে ১ কোটি ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৭৮৩ টাকা মূল্যের বাড়ি রয়েছে। আরও নিজ নামে ৮৩ লাখ ৫৪ হাজার ৪৬৮ টাকা মূল্যমানের দুটি অ্যাপার্টমেন্টের তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।
বার্ষিক আয়: বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও অন্যান্য ভাড়া বাবদ তার আয় ৮৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৫ এবং শেয়ার, সঞ্চয়/ব্যাংকে আমানত ১ কোটি ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯১ টাকা। চাকরি (ডিরেক্টর রিমোনেরেশন) থেকে আয় ১২ লাখ টাকা।
এ সময় তার নিজের নামে ৯৩ হাজার ৯২১ ও স্ত্রীর নামে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩৭ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার নিজের নামে ২ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৫ ও স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪২৫ টাকা ছিল।
এ ছাড়া বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে কাজী জাফর উল্লাহর নামে ১০ কোটি ৪ লাখ ৭৮ হাজার আর তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৫ কোটি ৮ লাখ ১১ হাজার ২০০ টাকা। এ সময় তার এফডিআর ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ, সঞ্চয়পত্র ছিল ১ কোটি ৫ লাখ এবং শেয়ারমানি ডিপোজিট ছিল ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকার। তার স্ত্রীর নামে ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার এফডিআর ও ৮০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।
আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতার আয়ের বড় উৎস হচ্ছে শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত। তিনি এ খাত থেকে বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার ৩১৪ টাকা বলে হলফনামায় ঘোষণা দেন। এর বাইরে তার বার্ষিক আয় হিসেবে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯৪ এবং চাকরি থেকে তার বার্ষিক আয় ১২ লাখ টাকা উল্লেখ রয়েছে। তবে কৃষি খাত ও ব্যবসা থেকে কোন আয় দেখাননি।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তৎকালীন ফরিদপুর-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাজী জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের কাছে হেরে যান তিনি। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নিক্সনের কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য।
পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম আসে কাজী পরিবারের। এর মধ্যে রয়েছেন কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ এবং ছেলে কাজী রায়হান জাফর।