ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল বাংলাদেশের সাময়িক অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদি নয়

#সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে না, এটি ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত: ড. জাহিদ হোসেন

#রপ্তানির বিকল্প পথ কাজে লাগাতে হবে: মোহাম্মদ হাতেম

জুলাই পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। এরপরেই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তার এ আশ্রয়কে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এতোদিন তা রাজনৈতিক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত সরকার। হঠাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এতে বাংলাদেশ সাময়িক চাপে পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হঠাৎ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিছক রাজনৈতিক। দেশের রপ্তানিকারকরা সাময়িকভাবে কিছুটা চাপে পড়বেন নিশ্চয়ই। তবে দীর্ঘমেয়াদে ভারত অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত যে ভুল পথে হাঁটছে এই সিদ্ধান্ত তার বড় প্রমাণ। তবে আমাদেরকে রপ্তানি বিকল্প পথ বের করতে হবে।
জানা গেছে, বুধবার (৯ এপ্রিল) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে জানায়, মঙ্গলবার ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস এই সুবিধা বাতিল করে আদেশ জারি করেছে। এর পাশাপাশি ২০২০ সালের ২৯ জুন দেয়া এ-সংক্রান্ত আদেশও বাতিল করা হয়। ওই আদেশে আরো বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ওই আদেশ অনুসারে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের একটি শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। এখন দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সুবিধা বাতিল করল। যেসব পণ্যবোঝাই যানবাহন ইতোমধ্যে ভারতের ভূখণ্ডে আছে, সেগুলো দ্রুত ভারতের ভূখণ্ড ত্যাগ করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয় আদেশে। সূত্র জানায়, ভারতের দুটি বন্দর ব্যবহার করে ইউরোপে পণ্য পাঠাত বাংলাদেশ। বিশেষত খাদ্য, কৃষি ও পোশাক পণ্য। কোভিডের সময় এ সুবিধা দেয় ভারত। এই সুবিধাটিই তারা এখন বাতিল করেছে।

পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার বিনিময়ে ভারত বিপুল রাজস্ব পেতো। ফলে এ বিনিময় সুবিধাটা এখন অন্য কোনো দেশে চলে যাবে। এর আগে ভারত ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানির এ সুবিধা দিয়েছিল। দেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর পর ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের এ খবর রপ্তানিকারকদের আরো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ফলে ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভুটান, নেপাল, মিয়ানমারসহ তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। দেশটির বিমানবন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্টও বন্ধ হয়ে গেলো।
মূলত নেপাল, ভুটানে পণ্য পাঠাতে বাংলাদেশকে ভারত কোনো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়নি। ভারতের সাথে নেপাল ও ভুটানের করা চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশ ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পাঠায়। সুতরাং যে সুবিধা বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি, সেটা বাতিল হওয়ার সুযোগ নেই।

নেপালে বা ভুটানে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয় নেপাল বা ভুটানের সাথে ভারতের চুক্তির ভিত্তিতে। স্থলবেষ্টিত দেশ হিসেবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার প্ল্যাটফর্মে নেপাল বা ভুটান (যদিও ভুটান ডব্লিউটিও সদস্য না) এই সুবিধা পেয়ে থাকে। এখানে বাংলাদেশের সাথে ভারতের চুক্তির কারণে এটা হচ্ছে না। সুতরাং বাতিলেরও প্রশ্ন আসে না। পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তখন জানানো হয় ভুটান ও নেপালে রপ্তানি এর বাইরে থাকবে।
এদিকে বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল দিল্লিতে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, বাংলাদেশকে বেশকিছু সময় ধরে দিয়ে আসা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার কারণে আমাদের বন্দর ও এয়ারপোর্টগুলোয় পণ্যজট তৈরি হচ্ছিল। এতে পরিবহনে দেরি ও বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমাদের নিজস্ব রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই ৮ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে এসুবিধা বাতিল করা হয়েছে। তবে এই পদক্ষেপ ভারতের মধ্যে দিয়ে নেপাল বা ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে কেন এটা করলো তারা। ভারত যে সার্কুলার দিয়েছে তাতে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য কারণ মনে হয়নি। মূলত তারা রাজনৈতিক কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আমাদের দেশে বড় একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হচ্ছে এই ঘটনায় সেখানেও ভালো বার্তা যাবে না। এখানে আসল চালিকাশক্তি রাজনৈতিক। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পিছু হটার মতো অবস্থা দাঁড়ালÑ যোগ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, নেপাল, ভুটান আর মায়ানমারের সাথে আমাদের বাণিজ্য প্রভাব তৈরি হবে। এখানে তৈরি পোশাক ও জুতা রফতানিতে সময় ও খরচ বেড়ে যাবে। এতো দিন সময় কম ব্যয় হতো, পরিবহন খরচও কম হতো। এখন দুই-ই বাড়তি খরচ হবে। আকাশ পথ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

সামগ্রিক অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আসলে এখানে রফতানির সংখ্যাগুলো এতো বড় না। নেপালে বছরে ৪৪ মিলিয়ন ডলার, মায়ানমারে ২৫ মিলিয়ন, ভুটানেও অল্প রফতানি হয়ে আসছে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা আসবে না। বিষয় হলো এমন একটা সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা যখন দেশের অর্থনীতি নানা ঝক্কি-ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা!

এদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়াতে বাংলাদেশের আমাদের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতির মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, কারণ আমাদের রফতানি করা পণ্য যেটা সেটা বেশি না। এছাড়া আমাদের বিকল্প অনেক পথ রয়েছে। সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তবে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে কেন ভারত সরকার হঠাৎ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলো সেটি পর্যালোচনা করা। আমাদের পর্যাপ্ত কার্গো বিমান সুবিধা থাকলে এই পথে হাঁটতে হতো না। সুতরাং সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।