ডেঙ্গু এবং মশাবাহিত অন্যান্য ভাইরাসজনিত অসুখের বিস্তার রোধ করতে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা পেশ করেছে জাতিসংঘের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক অঙ্গসংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহী তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস।
সংবাদ সম্মেলনে গেব্রিয়েসুস বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গু এবং আর্বোভাইরাস (মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়ের মাধ্যমে বাহিত ভাইরাস)জনিত বিভিন্ন রোগের অত্যন্ত দ্রুত বিস্তার দেখছি, যা একই সঙ্গে বিপজ্জনক এবং উদ্বেগজনক। গত কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ ডেঙ্গু ও আর্বোভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং এখন এসব রোগে আক্রান্ত-মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। বিভিন্ন দেশের সরকার যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, তাহলে এই ঝুঁকি থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।”
এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়বাহিত রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগ জাগিয়ে তুলছে ডেঙ্গু। ডব্লিউএইচও’র রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। চলতি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ২৩ লাখ মানুষ এবং তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজারেরও বেশি জনের।
“এই ডেঙ্গুকে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বেঁধে ফেলতে হবে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিকসহ বিভিন্ন কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা শত শত কোটি মানুষের সুরক্ষা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যত নির্মাণের জন্যই ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করতে হবে। এটি একটি সমন্বিত কাজ। ডেঙ্গু প্রতিরোধের ব্যাপারটির সঙ্গে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে শুরু করে এই রোগে আক্রান্ততের সঠিক সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবারই সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন গেব্রিয়েসুস।
বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সংস্থার গ্রীষ্মকালীন রোগ বিভাগের প্রধান এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. রমন ভেলাইউধান এবং আর্বোভাইরাস ও মহামারি প্রস্তুতি বিভাগের প্রধান ডা. ডিয়ানা রোজান আলভারেজও। ডা. ভেলাইউধান বলেন, “আমাদের জীবনযাত্রার সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় ডেঙ্গুর বিস্তারের জন্য সরাসরি দায়ী। যেমন—অপরিকল্পিনত নগরায়ন, দুষিত পানি, ত্রুটিযুক্ত পয়োঃনিষ্কাষন ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রভৃতি।”
“এই মুহূর্তে বিশ্বের ১৩০টিরও বেশি দেশে ডেঙ্গু মহামারি চলছে। এখনও এ মহামারি স্থানীয় পর্যায়ে থাকলেও আক্রান্ত-মৃত্যুর হার প্রতিবছরই বাড়ছে। একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মশাবহিত অপর দুই রোগ জিকা এবং চিকনগুনিয়ার ক্ষেত্রেও,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন ডা. ভেলাইউধান।
পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলকার জলবায়ু ডেঙ্গু ভাইরাস এবং এর বাহক এডিস মশার বিস্তারের জন্য উপযোগী। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত বিভিন্ন দেশ এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে তাই বরাবরই এই রোগের বিস্তার ছিল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছরই নতুন নতুন দেশে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু।
ডা. ডিয়ানা রোজাস আলভারেজ বলেন, “বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে সদ্যজাত শিশু এবং বয়স্ক লোকজন। এই মুহূর্তে বিশ্বের যত দেশে ডেঙ্গুর স্থানীয় মহামারি চলছে, সেসবের মধ্যে এমন বহু দেশ রয়েছে— যেগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত ও চিকিৎসার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠোমো ও উপকরণ নেই। এক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।”
“যেহেতু ডেঙ্গু এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, তাই সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রমেই একে মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকরী পথ।”
সূত্র : এএফপি, ভয়েস অব আমেরিকা