তিনটি ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী গ্ৰুপ দেশবন্ধু। ব্যাংকগুলোর বনানী শাখা থেকে এ গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট ৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। পরবর্তীতে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে গ্রুপটি। ব্যাংকগুলো হলো- বেসরকারি শরীয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
সূত্র বলছে, গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সিংহভাগ টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছে। সেখানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগও করেছে। এখন তিনি দুবাইয়ে আসন গেঁড়েছেন। পাচার টাকায় পাহাড় গড়ে রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আদায় অযোগ্য কুঋণ বা মন্দ ঋণ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; যা মোট খেলাপির ৮১ দশমিক ৬০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। কারণ এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যা তাদের নিট আয়ে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। শুধু তা-ই নয়, মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, দেশবন্ধু গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে।
দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিনটি ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে ৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৬৭৯ কোটি ৭৬ লাখ। আর নন-ফান্ডেডে রয়েছে ১২৭ কোটি ২১ লাখ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, ফুড এন্ড বেভারেজ লি., সুগার মিলস্ লি., দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস., দেশবন্ধু কনজ্যুমার এন্ড এগ্রো লি. ও এম.আর ট্রেডিং। যা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
দেশবন্ধু গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। যা এখন পুরোপুরিই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এই গ্রুপটি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দেশবন্ধু গ্রুপ ঋণ রিসিডিউলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন পাঠিয়েছিলো। সাথে আদালতের কিছু কাগজপত্র দিয়েছিলো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ব্যাংকগুলোর সাথে যোগযোগ করতে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, লোন রিসিডিউলের ব্যাপারে ব্যাংকগুলো যে পদক্ষেপ নেবে, সেই পদক্ষেপেই বাংলাদেশ ব্যাংক সমর্থন দেবে। এরপর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি ভালোই চলছিলো। কিন্তু পরে আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার অব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর না দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে গ্রুপটি।
জানা যায়, বিনা জামানতে আওয়ামী আমলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছিলো এই গ্রুপটি। ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান। ব্যাংকের টাকা না দিয়ে এই গ্রুপটি শুধু ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি চালিয়েছে। কালক্ষেপন করে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে এসআইবিএলের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ নাজমুস সায়াদাত বলেন, ‘একাধিবার চেষ্টা করেও দেশবন্ধু গ্রুপের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছিনা। টাকা চাইলে শুধু প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর আর খোঁজ থাকে না। তারা বড় বিপদে রয়েছেন। এই গ্রুপের বিরুদ্ধে এখন কঠোর পদক্ষেপ নিবেন বলেও জানান তিনি।’
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া জানান,‘ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি দেশবন্ধু গ্রুপ থেকে অর্থ আদায়ের। তবে তার অর্থ দেয়ার কোনো প্রকার চেষ্টা দেখছি না। তিনি শুধু কালক্ষেপন করেই যাচ্ছেন।’
দেশবন্ধু গ্রুপের ঋণের অর্থ আদায়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না জানতে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।