পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষ সারা বছর ঝিরি ও ঝরনার পানির ওপর নির্ভর হয়ে জীবনধারণ করে। ঘরের নিত্য ব্যবহার্য কাজসহ পানি পানের জন্য এই ঝিরি ও ঝরনার পানি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত বর্ষার সময় থেকে শীত মৌসুম পর্যন্ত এসব উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করা গেলেও মাঘ-ফাল্গুন থেকে পাহাড়ে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়।
সরকারের উদ্যোগে দুর্গম কিছু কিছু পাহাড়ি গ্রামে রিংওয়েল ও টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও শুকনো মৌসুমে এসব থেকে পানি পাওয়া যায় না। গ্রামবাসী আশপাশের নিচু জায়গায় কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমেও এসব কুয়া শুকিয়ে যায়। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ধুঁকতে হয় রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষকে। সরকারি হিসেবে, জেলায় প্রায় ৫৯ ভাগ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের অর্ধেক সময় বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে জেলার ৭০ ভাগ মানুষ পানির অভাবে পড়ে।
সরেজমিনে রাঙামাটি সদরের সাপছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম নাড়াইছড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামের ১১৩ পরিবার একটি পাহাড়ি ছড়ার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু শুকনো মৌসুমে ছড়াটি শুকিয়ে যায়। এতে খাবার পানিসহ নিত্য ব্যবহার্য পানির তীব্র কষ্টে ভুগছে এই গ্রামের মানুষ। পুরো গ্রামের ভরসা গর্ত খুঁড়ে তৈরি করা কয়েকটি কুয়ার ওপর। গ্রামের নারীরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে কুয়া থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে। এই পানি দিয়ে চলে পান করা থেকে ঘরের রান্নাবান্না ও ব্যবহারের কাজে। বর্ষা মৌসুমে পানি থাকলেও শুকনো মৌসুমে ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়তে হয় গ্রামবাসীদের।
গ্রামের বাসিন্দা সুবিমল চাকমা বলেন, শীতের শেষ দিক থেকেই আমাদের পানির কষ্ট শুরু হয়ে যায়। এখানে যে পানির ছড়া আছে সেটা শুকাতে শুরু করে আর গরমকালে একেবারেই শুকিয়ে যায়। তখন আমরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ছোট ছোট কুয়া তৈরি করে পানি সংগ্রহ করি।
আরেক বাসিন্দা জোনাকি চাকমা বলেন, সারাদিন জমিতে কাজ করে আসার পর গোসল পর্যন্ত করতে পারি না আমরা। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার জন্য অনেক দূর থেকে হেঁটে কুয়ায় আসতে হয় আমাদের। গ্রামে কোনো টিউবওয়েল বা ডিপ রিং ওয়েল নাই, তাই পানির জন্য আমাদের খুব কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।
১০৯নং সাপছড়ি মৌজার নাড়াইছড়ি গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) খুলমোহন কার্বারি বলেন, প্রতিবছর গ্রীষ্মের সময় পানির জন্য পুরো গ্রাম হাহাকার করে। আমাদের কৃষিকাজ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। ছড়ার পানি খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রামে রাস্তাঘাট না থাকায় অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেও আমাদের কষ্ট পেতে হয়। সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমাদের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হোক।
তবে এই চিত্র শুধুই নারাইছড়ি গ্রামের নয়। পুরো রাঙামাটির বেশিরভাগ পাহাড়ি অঞ্চলেই এই কষ্টে ভুগছে মানুষ। প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংসের কারণে শুকনো মৌসুমে পানির জন্য কষ্ট পেতে হচ্ছে জানালেন গ্রামের মানুষ।
গ্রামের বাসিন্দা জ্যোর্তিময় চাকমা বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে দেখেছি গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম ছিল এটি। কিন্তু এখন অধিকাংশ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, ফলে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়ে আমাদের পানি কষ্টে ভুগতে হচ্ছে।
রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, এই মুহূর্তে ৫৮.৪৭ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। বাকি যেটুকু আওতায় আসেনি সেখানেও পানির ব্যবস্থা করার জন্য আমরা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে আমাদের কমিউনিটি বেইজড পাইপ নেটওয়ার্ক সাপ্লাই স্কিম, রুরাল পাইপ নেটওয়ার্ক সাপ্লাই স্কিমসহ বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে আমাদের কাজ বাস্তবায়ন করে নিয়ে যাচ্ছি।
সরকারের বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে পাহাড়ি এই জেলার পানি সঙ্কট দূর করা সম্ভব বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।