নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে কেন শাপলা ফুলে আগ্রহ এনসিপি’র?

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে জাতীয় ফুল শাপলা প্রতীক চাওয়ার পর থেকে এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা দেখা গেছে ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এনসিপি নেতাকর্মীদের অনেকেই শাপলাকে প্রতীকের দাবিতে প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে রোববার থেকে। যদিও এর বাইরে কলম ও মোবাইল ফোনকে বিকল্প হিসেবে রেখেছে, কিন্তু দলটি মুল আগ্রহ শাপলা প্রতীকেই।

এর বিপরীত প্রচারণাও চলছে অনলাইনের বিভিন্ন প্রচারণায়। এতে অনেকেই দাবি করছেন বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলা। সেটি কোন রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না।

তবে এনসিপি বলছে, তারা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক নয়, জাতীয় ফুল শাপলাকে প্রতীক হিসেবে চেয়েছে।

কেন এনসিপি শাপলাকে দলীয় প্রতীক হিসেবে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে এমন প্রশ্নও সামনে আসছে।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “বাংলাদেশের নদী, প্রকৃতি ও জলাশয়ের সাথেই জড়িয়ে শাপলা। যে কারণে আমরা মনে করছি রাজনীতিতেও এর প্রতিফলন থাকুক। এটা আমাদের দলীয় প্রতীক হোক”।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে এনসিপিসহ নতুন আরো প্রায় দেড়শো রাজনৈতিক দল ইসিতে আবেদন করেছে নিবন্ধনের জন্য।

এনসিপি শাপলা প্রতীক চেয়ে আবেদনের তিনদিন আগে নাগরিক ঐক্য তাদের দলীয় প্রতীক কেটলি পরিবর্তন করে শাপলাকে প্রতীক হিসেবে চেয়ে আবেদন করেছে। তবে সে আবেদনে এখনো পর্যন্ত সাড়া দেয় নি ইসি।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন করে যে প্রতীকের তালিকা তৈরি হচ্ছে সেখানে যদি শাপলা আসে তখন এটা কেউ না কেউ পাবেই। আমরা শাপলাকে আদৌ যুক্ত করবো কিনা সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেই নি”।

তবে, নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন ১১৫টি নিয়ে রাজনৈতিক দলের জন্য নতুন খসড়া প্রতীক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে শাপলাও যুক্ত করা হয়েছে।

যে কারণে শাপলা পছন্দ এনসিপি’র
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রায় চার মাস পর নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে নির্বাচন কমিশনে।

বিকেলে এনসিপি আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নেতৃত্বে দল নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেন তারা।

এই আবেদনের সাথে তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে প্রথম পছন্দ ‘শাপলা’ চায়। এর সাথে বিকল্প হিসেবে কলম আর মোবাইল ফোনও প্রতীক হিসেবে চেয়ে রেখেছে এনসিপি।

নিবন্ধনের আবেদনের পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে দেখা করেন নাহিদ ইসলামসহ দলের শীর্ষ নেতারা। সেখানে তারা দলীয় প্রতীক শাপলা নিয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা সিইসির কাছে জানান।

সেখান থেকে বেরিয়ে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রথম পছন্দ শাপলা। আশা করছি, জনগণের মার্কা হিসেবে, গণঅভ্যুত্থানের মার্কা হিসেবে, গ্রাম বাংলার প্রতীক হিসেবে এনসিপি শাপলা পাবে”।

এত প্রতীকের মধ্যে শাপলাকে কেন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে সোমবার এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শাপলা আসলে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলাকে প্রেজেন্ট করে। এছাড়া বঙ্গীয় বদ্বীপের নদী ও জলাশয় ভিত্তিক ভূপ্রকৃতির সাথেই শাপলা জড়িত”।

এনসিপি মনে করছে, গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে শাপলা ফুল অনেকটাই পরিচিত। যে কারণ তারা এই প্রতীকেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রতীক হওয়া উচিত জনমানুষের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতীক হচ্ছে সেটা যেটার সাথে মানুষ নিজেদের কানেক্ট করতে পারে”।

“শাপলাটা হচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটা প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের প্রতিটা প্রান্তে শাপলার একটা উপস্থিতি আছে। যেটার সাথে মানুষ কানেক্ট করতে পারে। যে কারণে শাপলা প্রতীক হিসেবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ”, যোগ করেন মি. আব্দুল্লাহ।

শাপলা নিয়ে বিতর্ক কেন?
রোববার নির্বাচন কমিশনের কাছে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়ে আবেদনের পর এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা দেখা যায়।

ফেসবুক পোস্টে কেউ কেউ দাবি করেন, বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলা। যে কারণে এটি কোন একটি দলের প্রতীক হতে পারে না।

তবে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় প্রতীক হিসেবে যে শাপলার কথা দাবি করা হলেও, সেখানে শুধু শাপলা না, তার সাথে আছে ধানের শীষ ও পাটের কুড়ি পাতাও রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হচ্ছে, উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পরসংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা৷

এর ব্যাখ্যায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার ১৯৭২ এ বলা আছে আমাদের জাতীয় প্রতীক হবে শাপলা। এতে ধানের শীষ ও পাটের কুড়ি থাকলে, শাপলাটাই হচ্ছে মূল”।

যে কারণে সিনিয়র এই আইনজীবী মনে করেন শাপলা কোনও একটি দলের প্রতীক হতে পারে না। যে কারণে কোনও একটি দলকে শাপলা প্রতীক দেয়া উচিত হবে না বলেও মত দেন তিনি।

সাবেক সচিব ও নির্বাচন বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জাতীয় প্রতীকে আরো অনেক কিছু থাকলেও শাপলাটাই মূল। কেননা জাতীয় প্রতীকে শাপলাকে যতটা বড় করে দেখা যায় অন্য বিষয়গুলো অতটা ভালোভাবে বোঝা যায় না”।

পাল্টা যুক্তি দিয়েও কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় প্রতীকে শাপলার পাশাপাশি ধানের শীষও রয়েছে। যেহেতু জাতীয় প্রতীকের একটা অংশ ধানের শীষ বিএনপির দলীয় প্রতীক হিসেবে রয়েছে। সে কারণে শুধুমাত্র শাপলা ফুল প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।

সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন যদি বলেন শাপলা জাতীয় ফুল, তাই এটি কাউকে দেয়া যাবে না সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, নিবন্ধিত রাজনৈতিক একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক আছে”।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকায় দেখা যায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির দলীয় প্রতীক কাঁঠাল।

এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ এই উদাহরণ টেনে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জাতীয় ফুল কিংবা গাছ যদি দলীয় প্রতীক হতে পারে তাহলে জাতীয় ফুলে কেন আপত্তি থাকবে”?

শাপলা প্রতীক নিয়ে টানাটানি
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের দোসরা সেপ্টেম্বর রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।

গণ প্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রতীক দেয়া হয় কেটলি।

নিবন্ধন পাওয়ার নয় মাসের মাথায় গত ১৭ই জুন নির্বাচন কমিশনের কাছে দলীয় প্রতীক পরিবর্তনের জন্য আবেদন জানায় নাগরিক ঐক্য।

তারা দলীয় প্রতীক ‘কেটলি’র পরিবর্তে শাপলা বা দোয়েল পাখি বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করে।

এনসিপির আবেদনের মাত্র কয়েকদিন আগে কেন হঠাৎ ‘শাপলা’ বা ‘দোয়েল’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

জবাবে মাহমুদুর রহমান মান্না বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা আগে একটু কনফিউজড ছিলাম জাতীয় প্রতীককে ইসি দলীয় প্রতীক হিসেবে দিবে কি-না। পরে মনে হলো আবেদন করি। তাই আমরা ইসিতে আবেদন করেছি”।

কী করবে নির্বাচন কমিশন?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৫০টি।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনের জন্য বর্তমানে ইসির তফসিলভুক্ত ৬৯টি প্রতীকের মধ্যে ৫০টি প্রতীক বরাদ্দ রয়েছে রাজনৈতিক দলের জন্য। যার মধ্যে স্থগিত হওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও প্রতীক রয়েছে।

কিন্তু আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে এরই মধ্যে প্রায় দেড়শ রাজনৈতিক দল ইসির কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।

চূড়ান্ত যাচাই বাছাই শেষে এর মধ্যে যে সব দল ইসির নিবন্ধন পাবেন তাদেরকেও প্রতীক বরাদ্দ দিতে হবে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যও রাখতে হবে নতুন প্রতীক।

যে কারণে ৬৯টি থেকে ইসির তফসিলভুক্ত প্রতীকের সংখ্যা বাড়িয়ে ১১৫টি প্রতীকের খসড়া প্রস্তুত করেছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের অন্তত দুইজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন যে, এই খসড়া তালিকায় শাপলা ফুলকে দলীয় প্রতীক হিসেবে রাখা হয়। তবে সেটি এখনো চূড়ান্তভাবে ইসির অনুমোদন পায় নি।

প্রশ্ন উঠেছে যদি চূড়ান্তভাবে শাপলা দলীয় প্রতীক হিসেবে তফসিলভুক্ত হয়, তাহলে সেটি কোন রাজনৈতিক দলকে দেয়া যাবে?

জবাবে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রতীক তালিকায় সংশোধন এনে শাপলা অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, “শাপলা যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন আমরা দেখবো এটার দাবিদার কে কে? তখন অনেক দাবিদার হলে কার দাবিটা বেশি অগ্রগণ্য সেটা দেখবো। তবে এ নিয়ে আগে থেকেই কিছু বলা যাচ্ছে না”।
বিবিসি বাংলার ।