রাজধানীর উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের চিৎকার, স্বজনদের আহাজারি আর অস্থিরতা মিলিয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এলাকা এখন যেন এক অনন্ত দুঃখের উপাখ্যান। দিগবিদিক ছুটছেন স্বজনেরা। কারো হাতে প্রেসক্রিপশন, কারো চোখে অশ্রু। হাসপাতালের গেট পেরিয়ে যখন তারা ওষুধের খোঁজে ছুটছেন, ঠিক তখনই তাদের পকেটে চেপে বসছে এক অদৃশ্য হিংস্র ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। ওষুধের দাম বাড়িয়ে চড়া দামে বিক্রির অভিযোগ উঠছে একের পর এক ফার্মেসির বিরুদ্ধে। মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল পণ্যের দামও আদায় করা হচ্ছে বাড়তি মূল্য।
গেটে দাঁড়িয়েই দেখা গেল, এক রোগীর স্বজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে এক পুলিশ সদস্যকে বলছেন- ‘ভাই, দেখেন না। আমার ওষুধের দাম ৩০ টাকা, আর ওরা ১৩০ টাকা রাখছে!’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্য নির্বিকার মুখে বলে ফেললেন, ‘আপনি সেনাবাহিনীকে বলেন।’
হতাশ হয়ে দ্রুত হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়েন তিনি। পরে ওই পুলিশ সদস্য সাংবাদিককে বলেন, ‘এটা প্রতিদিনের চিত্র। এদের সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। এমন অসহায়ত্ব ভরা ক্ষোভ প্রায়শই শুনি। তাই সেনাবাহিনীকে জানাতে বললাম।’
সোমবার (২১ জুলাই) রাত আটটার দিকে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় প্রতিবেদক। বার্ন ইউনিটের সামনের উপশম মেডিকেল হল ফার্মেসির কাছে গাইবান্ধা থেকে আসা মুমিনুল ইসলাম দাঁড়ান মেয়ের অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র তুলে ধরতেই দোকানি একে একে ওষুধ হাতে ধরিয়ে দেন। ওষুধের দাম নেন ৬ হাজার ৮০০ টাকা। মেমো চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। পরে ওই ওষুধের দাম যাচাই করেন ভুক্তভোগী। দেখা যায়, অন্তত দেড় হাজার টাকা বেশি রাখা হয়েছে। শুধু অর্থ বেশিই না, সার্জিক্যাল পণ্যও দেওয়া হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ। এরপর পুলিশের সহযোগিতা চাইলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা দোকানে যান। দোকানি তখন দাবি করেন, ওষুধগুলো বিদেশি, তাই দাম বেশি। অন্যরা চুরি করেও আনতে পারে। একারণে দাম কম রাখতে পারে। আমি পারবো না।
কিন্তু ক্যাশ মেমো কিংবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কিছুই দেখাতে পারেননি। উল্টো ঘটনা আড়াল করতে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আয়া-নার্সদের বিরুদ্ধে ওষুধ চুরি করে বিক্রির অভিযোগ তুলে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন।
পুলিশ সদস্যরা যখন দোকানির কাছে ডকুমেন্টস দেখতে চান, তখন তিনি জানিয়ে দেন, দোকানটি নাকি মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এডিসি) শরিফুল আলমের বাবার। ফোন করে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলানোর চেষ্টা করেন দোকানি। যদিও পুলিশের এসআই প্রথমে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান, পরে আলাপ হয় এবং দোকানির আচরণে পরিবর্তন আসে। তিনি রোগীর স্বজনকে কিছু টাকা ফেরত দিতে সম্মত হন। এরপরও দোকানি রীতিমতো ধমক দিয়ে বলেন, তিনি আর ওষুধ বিক্রি করবেন না। পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে উঠলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার হুমকি দেন। এরপরই দোকানি ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাত্র দুশো টাকা ফেরত দেন এবং পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে সরে যান। মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল পণ্য আর বাড়তি দামে কেনা ওষুধ নিয়েই তিনিও দ্রুত হাসপাতালে চলে যান।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সমস্যা হতে পারে তাই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই এসআই বলেন, ‘পরিস্থিতি এমনিতেই খারাপ। আমরা সাধারণভাবে বিষয়টা মিটমাট করলাম। আর যিনি ফোনে কথা বলছিলেন, তিনি মালিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। যদিও দোকানি দাবি করে গেছেন, প্রতিষ্ঠানটি মিরপুর জোনের একজন কর্মকর্তার বাবার মালিকানাধীন। এমন একটা সংকটাপন্ন অবস্থায় মানুষ এমতেই বিপদে। এরমধ্যে এরা এগুলা করছে।’
মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এডিসি) হিসেবে শরিফুল আলম আছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই জোনের সরকারি নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও ফোন রিসিভ না করায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘ফার্মেসিগুলোর সিন্ডিকেট খুব বেপরোয়া। আমার কাছেই ৬০০ টাকার ওষুধ ৬ হাজার টাকার বিল করেছে! এসব ফার্মেসি সব সিলগালা করে দেওয়া উচিত। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে বিন্দুমাত্র ভয় করে না।’
ভুক্তভোগী মুমিনুল ইসলামের কণ্ঠে তখনও অসহায়তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘গরিব মানুষ। মেয়েটার জীবন বাঁচানোর জন্য সবকিছু করতে রাজি। মেমো চেয়েছিলাম, দিল না। কত টাকা বেশি নিয়েছে বুঝতে পারিনি। পড়াশোনাও তেমন জানি না। অচেনা ঢাকা শহরে কার কাছে বলবো?’
এই অভিযোগ শুধু এক ফার্মেসি ঘিরেই নয়। আশেপাশের প্রায় সব দোকানেই রোগীর স্বজনদের এমন প্রতারণার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত দাম, ক্যাশ মেমো না দেওয়া এবং ওষুধ না থাকার অজুহাতে বিকল্প ওষুধ ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা যেন অধরা। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে এই সিন্ডিকেট দাবি ভুক্তভোগীদের।
আকবর আলী নামে এক রোগীর স্বজন বললেন, আমরা যে কোন বিপদে পড়েছি, সেটা আমি আর আল্লাহ জানি। বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে ভাইয়ের ছেলে। আমি শুধু দৌড়াচ্ছি। এখন তো নতুন রোগী এসেছে। সবাই নতুনদের নিয়েই ব্যস্ত। আর আমাদের হাতে শুধু ওষুধের স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বলা হচ্ছে। ওষুধের দোকান, হাসপাতালের বারান্দা, আবার ওষুধের দোকান। এরমধ্যেই আছি। আর ফার্মেসিতে মেমো চাইলে কেউ দেয় না। সব জায়গায় ঠকছি, কিন্তু বলবো কাকে? অচেনা শহরে অভিযোগ করে যদি নতুন বিপদ বাড়ে, তখন কেউ দেখবে না।
এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ