আজ পহেলা বৈশাখ-বাংলা নববর্ষ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি। ১ বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় বাংলা নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ।
এবারের পহেলা বৈশাক যেন নব বারতার, নতুন উজ্জীবনের। তরুনদের মাঝে নতুন উদ্দীপনা। চারুকলায় ভিন্ন সাজ, দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরাজ করছে এক ভিন্ন আবহ। আজ পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে সারাদেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি।
একটি অসম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মূল সূত্র ধরেই এ নববর্ষের সূচনা। আর এ সূত্রের জনক তৎকলীন ক্ষমতাসীন সম্রাট আকবর। তিনি ধর্মীয় সংস্কার ও কৃষকের উন্নত জীবন তৈরির ঘোষণা করেছিলেন এ উৎসবের মাধ্যমে। মূলত তার নির্দেশে হিজরি সন অনুসারে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বছরের গণনা তাদের বিভিন্ন মনীষী না ধর্মীয় গুরুর জন্মদিনকে ঘিরেই বছর গণনা করা হয়। বাংলা মাস তার ব্যতিক্রম। তাই বাংলা নববর্ষ প্রকৃতি নির্ভর লোক উৎসব, এ উৎসবে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। অতি প্রাচীনকাল থেকে এ উৎসব চলে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশে এ উৎসব খুব জাঁকজমকভাবে পালিত হয়। বাঙালি তার আত্মপরিচয় তুলে ধরতে প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত দিকগুলো ফুটিয়ে তুলে নানা আয়োজনে।
আর তাই বৈশাখের উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানী এবং সারাদেশ জুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ পরিবর্তে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, আজ সোমবার সকাল ৯টায় এ শোভাযাত্রা শুরু হবে।
শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে শোভাযাত্রা। যারা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান, তারা কেবল নীলক্ষেত ও পলাশী মোড় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, শোভাযাত্রা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রবেশ পথ ও সংলগ্ন সড়ক বন্ধ থাকবে। ‘শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য রক্ষায়’ আশপাশ দিয়ে শোভাযাত্রায় প্রবেশ করা যাবে না। শেষ প্রান্ত দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার অনুরোধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য লোক-ঐতিহ্য ও ২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে আরো বড় পরিসরে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে এবছর শোভাযাত্রায় সর্বজনীন অংশগ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে। শোভাযাত্রায় এবছর ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিবৃন্দ অংশ নেবেন। এ বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় এবছর থাকবে ৭টি বড় মোটিফ, ৭টি মাঝারি মোটিফ এবং ৭টি ছোট মোটিফ।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের আগ্রহের কমতি নেই। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোর সব জয়ধ্বনি কর ওই নূতনের কেতন ওড়ে, কালবৈশাখী ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। কবির ডাকে সাড়া দিয়ে দোকানে দোকানে শুরু হয়েছে লাল-সাদা পোশাকের সমাহার। পথে পথে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছেন ডুগডুগি, নলখাগড়ার বাঁশি, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-মোড়া। ওদিকে চারুকলায় রীতিমতো সাজ সাজ রব চলছে। আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর সে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। ছায়ানটের শিল্পীরা এ দিন খুব ভোরবেলা থেকেই সম্মিলিত কণ্ঠে বৈশাখী আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান। এই উৎসবটিরও ইতিহাস আছে। পাকিস্তানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ওপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।
ঢাকার পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’; যা এতোদিন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পালিত হতো। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ১৯৮৯ সালে। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেই চারুকলা ইসস্টিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশে আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেয়া হয়। কোনো বছর থিম রাখা হয় হাতি, কোনো বছর কুমির, কোনো বছর বাঘ। আবার কখনো এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়।
বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও অস্ট্রলিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেনসহ বিশ্বের আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে যেমন : সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরাতে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাচ-গান-ফ্যাশন শো-খাবারের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এ ধারাকে আনন্দময় করে তোলে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে বার্নউড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলেও ২০০৬ সাল থেকে সিডনি অলিম্পিক পার্কে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিপুল পরিমাণ লোকের সমাগম ঘটে এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দঘন দিন।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, বাঙালির মহামিলনের দিন। এদিন সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে নব-অঙ্গীকারে। বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি এই দিনটি পালন করে। যে সংস্কৃতি মানুষের তৈরি আবার সে সংস্কৃতি ছাড়াও মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব জাতি তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে তার সৃষ্ট সংস্কৃতিকেও আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, চর্চা করতে হয়, মনে-প্রাণে লালন করতে হয়।
প্রত্যেক জাতির ন্যায় বাঙালি জাতিরও নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তাই বাঙালিরা তাদের এ সংস্কৃতি মনে-প্রাণে লালন করে যায় বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের মধ্য দিয়ে। সারা বছরের বিষণ্নতাকে কাটিয়ে উঠতে বাংলা সনের বছরের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে থাকে বাঙালি জাতি। সেদিন সুপ্রভাতের ফসলের মাঠ, সূর্যকিরণ, মৃদু বাতাসের সুর নতুনের বার্তা দিয়ে যায়। বাঙালির শাশ্বত কামনাই হলো এ নতুনের প্রতি প্রেম। পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে উৎসবের আয়োজন তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। এ দিনটি বাংলা বছরের প্রথম দিন।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে-দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব।