বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির এর তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল অনুষ্ঠিত এ (১৬ এপ্রিল) উক্ত সভায় বিএসইসি-কে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক গঠিত কমিটির সভাপতি এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকুল ইসলাম, কমিটির সদস্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বীমা ও পুঁজিবাজার অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ সাঈদ কুতুব এবং কমিটির সদস্য সচিব ও বিএসইসি’র কমিশনার ফারজানা লালারুখ উপস্থিত ছিলেন।
এসময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় বিশেষ আমন্ত্রণের ভিত্তিতে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, বিএসইসি’র কমিশনার মুঃ মোহসিন চৌধুরী, বিএসইসি’র কমিশনার মোঃ আলী আকবর এবং পুঁজিবাজার অংশীজন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের শীর্ষ প্রতিনিধিবৃন্দ। রাজধানীর আগারগাঁও-এ বিএসইসির মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত উক্ত সভার প্রথমাংশে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর কর্মকর্তাবৃন্দ এবং দ্বিতীয়াংশে পুঁজিবাজারের অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় হয়।
কমিটির সভার প্রথমাংশে বিএসইসির কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে মতবিনিময় হয়। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালকগণ, পরিচালকগণ ও কমিশন সচিব সভার উক্ত অংশে অংশগ্রহণ করেন। কমিটির সদস্য সচিব ও বিএসইসি’র কমিশনার ফারজানা লালারুখ সভার সূচনা করেন এবং সকলকে স্বাগত জানান। এসময় বিএসইসির পরিচালক মোঃ আবুল কালাম একটি প্রেজেন্টেশন প্রদান করেন। এসময় বিএসইসির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি কতৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সম্পর্কে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মহোদয়কে অবহিত করা হয়। সভায় বিএসইসির ইতিহাস ও কার্যাবলী, পুঁজিবাজারের আইনগত কাঠামো, পুঁজিবাজারের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি, ইকো-সিস্টেম, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারের তুলনামূলক চিত্র, পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জসমূহ, নেগেটিভ ইক্যুইটি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এছাড়াও বিএসইসি’র অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়সহ বিএসইসি ও পুঁজিবাজারকে শক্তিশালীকরণের পথে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহের উপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন কমিটির সভাপতি ও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী ।
কমিটির সভার দ্বিতীয়াংশে পুঁজিবাজারের অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় হয়। এসময় পুঁজিবাজার অংশীজন হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি (ডিএসই) এর চেয়ারম্যান মোঃ মোমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি (সিএসই) এর চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবদুল মোতালেব, সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) এর বাবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আ স ম খায়রুজ্জামান, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মো. সাইফুদ্দিন, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এর সভাপতি মাজেদা খাতুন, অ্যাসোসিয়েশন এব আাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি আন্ড মিউচুয়াল ফান্ডস (এএএমসিএমএফ) এর সহ-সভাপতি ওয়াকার আহমেদ চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি (এসিআরএবি) এর সভাপতি এনকেএ মবিন এফসিএ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) এর সভাপতি রুপালী হক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। পুঁজিবাজারের অংশীজনবৃন্দ বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি, টার্নওভারের উপর উৎসে কর কমান, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের পার্থক্য বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে নেগেটিভ ইক্যুইটির সমাধান, ভালো ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি, পণ্যের বৈচিত্রায়ন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বাস্তবায়ন, বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারের বাজার কাঠামো আধুনিকায়ন, সিসিবিএল এর বাস্তবায়ন, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয় বৃদ্ধি, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন রিভিউ, বিভিন্ন প্রনোদনা বা সুবিধার প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী করা, পুঁজিবাজারে অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, লভ্যাংশ আয়ের উপর কর রেয়াত বৃদ্ধি, মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগে রিবেট সুবিধা বৃদ্ধি, মিউচুয়াল ফান্ডের আইপিও কোটা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ নীতিমালা প্রস্তুতকরণ, পুঁজিবাজারে সকল পর্যায়ে অটোমেশন বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি সরকারের নীতি সহায়তার বিষয়ে সভায় প্রস্তাবনা রাখেন।
বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব ও বিএসইসি’র কমিশনার ফারজানা লালারুখ সভায় অংশগ্রহণকারী সকলকে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন জন্য মতামত প্রদানের অনুরোধ জানান। বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি। তিনি পুঁজিবাজারের অংশীজনদের বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের বিষয়ে লিখিত প্রস্তাবনা প্রদানের আহ্বান জানান। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিকে শিগগিরই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সভায় মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী মতবিনিময় সভার আয়োজন ও সফল বৈঠকের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত মতামত এবং প্রস্তাবনা তুলে ধরার জন্য বিএসইসি ও বাজার অংশীজনদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের নিকট হতে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, সংস্কার ও প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটির নিকট প্রেরণের অনুরোধ জানান। সরকার পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কার নিশ্চিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দেশের উন্নয়ন ও সংস্কার তথা পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন না হলে দেশ এগোতে পারবে না। শুধু বিদেশি অনুদান নির্ভর না হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য যে ফান্ড বা বিনিয়োগ প্রয়োজন তা দেশের মধ্য থেকেই সংগ্রহ করতে হবে এবং সেজন্যই দেশের পুঁজিবাজারের উন্নতি দরকার। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সবাই একসাথে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য কাজ করবো।” সর্বোপরি দেশের কল্যাণের স্বার্থে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কার নিশ্চিতের আশ্বাস দেন তিনি।
বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিএসইসি কার্যালয়ে আগমন এবং সভায় অংশগ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী মহোদয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানান। তিনি সভায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও দেশের পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়সমূহ সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি-কে অধিকতর শক্তিশালীকরণ এবং দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কারে সহায়তার অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। তিনি অন্যান্যের মধ্যে বলেন, “পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি প্রয়োজন। দেশের পুঁজিবাজার গত ১৫ বছরে ভালো কোম্পানি পায়নি। ভালো কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসাও চ্যালেঞ্জ। ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তির জন্য বিএসইসি চেষ্টা চালাচ্ছে। পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে খুব দ্রুতই পাবলিক ইস্যু রুলস এর সংস্কার করা হবে যা ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিতে সহায়ক হবে।” তিনি দেশের অর্থনীতিকে পুঁজিবাজারমুখী করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
বিএসইসির কমিশনার মুঃ মোহসিন চৌধুরী সভায় অন্যান্যের মধ্যে বলেন, পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং রেগুলেটরি কাঠামোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তিনি বিএসইসির জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন এবং এবিষয়ে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বিনিয়োগ শিক্ষার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে পুঁজিবাজার ভিত্তিক ভালো আবাসিক ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার উপর জোর দেন। তিনি একইসাথে গবেষণা ও উন্নয়ন এর উপর আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
বিএসইসিকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ ও পুঁজিবাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক গঠিত কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকুল ইসলাম সভায় অন্যান্যের মধ্যে বলেন, “দেশের পুঁজিবাজারের বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণ বাড়াতে না পারলে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে না। একইসাথে দেশের বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন আবশ্যক। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায় সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদহার।” সর্বোপরি দেশের আর্থিক খাতের সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।