প্রতিকূলতার মাঝেও চমক দেখাচ্ছে জনতা ব্যাংক

# ৬ মাসে আমানত বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি

# বর্তমান টিমের একাগ্রতা আর শ্রমই ব্যাংকটিকে সফলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে : এমডি

মরিয়ম সেঁজুতি
দেশের ব্যাংক খাত নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে। একের পর এক দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আমানতকারীদের জমা করা টাকা ফেরত দিতে পারছে না অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মূলধন ঘাটতি, লাগামহীন ঋণখেলাপি এবং তহবিল সংকটে পুরো খাতটিই টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। এমনকি আমানত সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। দেশের ব্যাংকিং খাতের এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ঢুবতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক ঘুরে দাড়াতে চেষ্টা করছে। ৬ মাসে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি আমানত সংগ্রহ করেছে। এলসি পেমেন্টে বিশাল একটি গ্যাপ ছিল, প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন। বর্তমানে তার প্রায় পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে। মাত্র ২৩ মিলিয়ন বকেয়া রয়েছে। এর দ্বারা জনতা ব্যাংকের বড় ধরনের সক্ষমতার জানান দেয়া হয়েছে বলে মনে করছে ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষ দিকে আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ কোটি টাকার একটু বেশি। এখন আমানত বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
গত বছরের ৭ নভেম্বর ব্যাংকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন মো: মজিবর রহমান। জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিকখাতে প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী, বিচক্ষণ ব্যাংকার মজিবুর রহমান যোগ দিয়েই ব্যাংকটিকে ঘুরে দাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেন। তার সেসব পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ণও ইতিমধ্যে র্দশ্যমান হচ্ছে। জানা গেছে, এর আগে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি হিসেবেও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ২৬ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি রূপালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার শাখাব্যবস্থাপক, জোনাল অফিসের হেড, বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান এবং প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আরও পড়ুনঃ জনতা ব্যাংকের নতুন পরিচালক মোঃ ওবায়দুল হককে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের শুভেচ্ছা
ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেন। তবে দেশের আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে গত ১০ মাসেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। অনেক ব্যাংক গ্রাহককে টাকা পরিশোধ করতে ব্যার্থ হচ্ছে। ঋণ দিতে পারছে না। সাধারণ গ্রাহকের মাঝে আস্থাহীনতা ও আতঙ্কের কারণে ব্যাংকগুলো আমানতও পাচ্ছে না। অথচ এমন পরিস্থিতিতেও মাত্র ছয় মাসে জনতা ব্যাংক আমানতে রেকর্ড গড়েছে, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। যোগদানের পর থেকেই ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটাই মজবুদ করতে সক্ষম হয়েছি। গ্রাহকের আস্থা ফিরাতে কাজ করছি। ফলে কয়েক মাসেই আমানত বেড়েছে।
ব্যাংকটিতে বর্তমানে মোট ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭১ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কী ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জানতে চাইলে মজিবর রহমান বলেন, রিকভারির ক্ষেত্রে আমারা বিভিন্ন ধরনের কমিটি করেছি। টাক্সফোর্সের মিটিংয়ে থাকছি। এছাড়া যতগুলো টুলস আছে যথাযথ নিয়ম মেনেই তা করছি। বিশেষ করে বড় ঋণের বিষয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে তিনবার বৈঠক হয়েছে। ঋন আদায়ের ক্ষেত্রে যতগুলো টুলস আছে, যেমনÑ যেখানে সুদ মওকুফের সুযোগ আছে, সেখানে সুদ মওকুফ করা হচ্ছে। কিছু আবার ওয়ান টাইম এক্সিটের সুযোগ রয়েছেÑ তার সবই ব্যবহার করছি। ২০২৪ সালে সারা বছরে ৪৭ কোটি টাকা ক্যাশ রিকভার ছিল, এ বছর এ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫ মাসেই প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্যাশ রিকভারি হয়েছে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর বিষয়ে এ ব্যাংকার বলেন, রেমিট্যান্সে আমরা বরাবরই এগিয়ে ছিলাম। গত বছরে সব ব্যাংকের মধ্যে আমরা তৃতীয় হয়েছি। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম হয়েছি। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরেও থাকবে মনে করি। কারণ এখনই আমাদের গ্রোথ অনেক বেশি। আমরা আশা করছি, গত বছরর তুলনায় এবারে দ্বিগুণ রেমিট্যান্স আহরণ করতে সক্ষম হবো।
নাজুক অবস্থায় থাকা ব্যাংকটিকে ছয় মাসেই সক্ষম করে তোলার পেছনে কী ধরনের ম্যাজিক কাজ করেছে, এমন প্রশ্নে মজিবর রহমান বলেন, এই ব্যাংকে যোগদানের পরে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ধার করে ডিপোজিটরদের দিতে হয়েছে। সেখানে ২৪ মে পর্যন্ত সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট হয়েছে। সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট বেশি এসেছে। যোগদানের পরে প্রতিদিন মনে হতো আমার নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত (এসএলআর) কম হবে। ত্রাহি ত্রাহি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বড় আমানতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র আমানত সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়। আমি দেখলাম, ক্ষুদ্র আমানত সংগ্রহ করতে হলে পুরো মাঠকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এজন্য ব্যাংকের সব শ্রেণীর কর্মকর্তাকে বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুযোগ করে দিয়েছি। তাদেরকে পার্সোনাল টার্গেট দিয়েছি। কর্মকর্তারা তাদের প্রমোশনের জন্য মাঠে নেমে গেছে। সম্মিলিতভাবে মাঠে নামার কারণে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার আমানত বেশি সংগ্রহ হয়েছে।
তিনি আরো বলন, এককথায় বলা যায় আমার ব্যাংকের বর্তমান টিমের একাগ্রতা আর শ্রমই আমাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকের পুরো টিমকে উজ্জীবিত করতে পেরেছি এবং আমার একটি লক্ষ আছে। সে লক্ষ অর্জনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহোদয়ও সব ধরনের সহযোগিতা করছেন। সে কারণেই এত বৈরি পরিবেশের মধ্যেও আমরা নতুন নতুন পণ্য বাজারে এনেছি। সফলতার চিন্তা করছি। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে, আমার চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি সবার অবদান রয়েছে।
চলতি বছরে কতটি পণ্য বাজারে এসেছেন জানতে চাইলে এমডি বলেন, ইতিমধ্যে আমাদের তিন পণ্য বাজারে আাছে, আরো দুটি পণ্য পাইপলাইনে আছে। শিগগিরই তা বাজারে নিয়ে আসা হবে।