চাকরির শুরুতে ১১তম গ্রেডে বেতনসহ তিন দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।
আজ সোমবার থেকে তাদের এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে এক কোটিরও বেশি শিশু শিক্ষার্থী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরাও কিছুটা দেরিতে পাঠ্যবই পেয়েছে। পুরোদমে ক্লাস শুরু করতেও এক-দেড়মাস দেরি হয়েছে। মে মাসের শুরু থেকে কখনও এক ঘণ্টা, কখনও দুই ঘণ্টা, আবার অর্ধদিবস কর্মবিরতি করেছেন শিক্ষকরা। সামনে ঈদুল আজহার ছুটি। ৩ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ঈদ ও গরমের বন্ধ থাকবে। ফলে বছরের অর্ধেক সময় পার হলেও পর্যাপ্ত ক্লাস করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, কর্মবিরতির ডাক দেওয়া প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তারা ধারাবাহিকভাবে দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার তাদের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা টানা কর্মবিরতি কর্মসূচি দিয়েছেন।
তবে এখন আন্দোলনের উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক। তবে তাদের এ দাবি পূরণের সক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। নির্বাচিত সরকার এলে তাদের দাবি-দাওয়া জানানো উচিত ছিল।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সবশেষ তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫ জন। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে এক কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন। অর্থাৎ, প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫৬ শতাংশই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কোনো ইচ্ছা শিক্ষকদের নেই বলে জানিয়েছেন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে দাবি আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে একবার আমরা বসেছি, সেখানে আমরা তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাইনি। বাধ্য হয়ে কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিতে নেমেছি আমরা। আশা করি, সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
সরকারি প্রাথমিকে ছুটিই ১৮০ দিন
বছরের শুরুতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাপঞ্জি প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে মোট ৭৮ দিন ছুটি (প্রধান শিক্ষকের হাতে সংরক্ষিত ৩ দিনসহ) রাখা হয়েছে। তাছাড়া শুক্র ও শনিবার দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। ফলে এক বছরে সাপ্তাহিক ছুটিই ১০৪ দিন। এবার দুই শনিবার স্কুল খোলা রাখায় তা ১০২ দিন হবে। সবমিলিয়ে এক বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে ১৮০ দিন।
শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ের বেসরকারি বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনগুলোর তুলনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি বেশি। বেসরকারি স্কুলে ক্লাসও বেশি হয়। এতে শিশু শিক্ষার্থীদের ভিত্তি তৈরির স্তর প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে। শিখন ঘাটতি নিয়েই তারা মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা শুরু করছে।
তিন দাবিতে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা
রাজশাহীর পবার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে আজিজুর রহমানের মেয়ে। বিদ্যালয়ের পড়ালেখায় সন্তুষ্ট নয় আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশেই প্রাইমারি স্কুল। মেয়ে স্কুলে যায়, কিন্তু ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আমরা নিজ চোখে সেটা দেখি। আজ এ কারণে বন্ধ, কাল ও কারণে বন্ধ। বছরজুড়ে বন্ধ লেগেই থাকে।’
আজিজুর রহমান বলেন, ‘স্কুলে নারী শিক্ষক বেশি। তারা ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাইরে অধিকাংশ সময় গল্প-আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন। এগুলো নজরদারি করা উচিত। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি কমানো দরকার।’
‘দাবি যৌক্তিক, সময়টা আন্দোলনের উপযুক্ত নয়’
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তবে বর্তমান সময়টা এ দাবি আদায়ে আন্দোলনের উপযুক্ত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষকরা বঞ্চিত। শুধু প্রাথমিক নয়, সব স্তরের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুব কম। এটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছি। তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো খুব জরুরি। ফলে তাদের দাবি যে যৌক্তিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তারা যে সময়টা আন্দোলনের জন্য; কর্মবিরতির জন্য বেছে নিয়েছেন, সেটা উপযুক্ত নয় বলে মনে করি।
কী কারণে এটি উপযুক্ত সময় নয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন, করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি শুরু হয়। সেটা পুরোপুরি এখনো পূরণ হয়নি। কারণ সে সময় যারা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল, তারা এখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে। এরপর গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। আবহাওয়াগত কারণেও বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। শীতে তীব্র শীত, তো গরমে প্রচণ্ড গরম। বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধ রাখে সরকার।
‘আমি মনে করি, এত এত সমস্যার পর এখন শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটা না করে শিক্ষকরা যদি আন্দোলনে নেমে পড়েন, কর্মবিরতি করেন; তাহলে তা খুবই দুঃখজনক। তাছাড়া এবার শিক্ষার্থীরা দেরিতে বই হাতে পেয়েছে। ক্লাসও দেরিতে শুরু হয়েছে। আর সরকার শিক্ষকদের কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে, সামনে হয়তো আরও বাড়াবে। সেজন্য আমি মনে করি, নির্বাচিত সরকারের আসার আগে এর চেয়ে বেশি দাবি আদায় সম্ভব নয়। সেটি বিবেচনা করে এখন আর আন্দোলন না করাই উত্তম হবে’ যোগ করেন রাশেদা কে চৌধুরী।