প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিদের উন্নয়নে ১১টি দাবি

বর্তমানে বাংলাদেশের পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে প্রান্তিক খামারিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বড় কোম্পানির সিন্ডিকেট, উৎপাদন খরচের বৈষম্য এবং অস্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থার কারণে তাদের ব্যবসা পরিচালনা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিদের উন্নয়নের জন্য নিচে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরছি যা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

১। ডিম মুরগি উৎপাদনকারী খামারিদের জন্য, ট্রেনিং সার্টিফিকেট খামার নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ও বিক্রয় রশিদ বাধ্যতামূলক করা সকল প্রান্তিক খামারি এবং কর্পোরেট কোম্পানিকে মুরগি ও ডিম বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রশিদ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি খামারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে নিবন্ধন থাকতে হবে এবং খামার পরিচালনার জন্য সরকারি প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। খামারিদের ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করে সরকারি নিয়মের আওতায় আনতে হবে। এতে সরকারের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ ডিম ও মাংস উৎপাদন নিশ্চিত হবে এবং পোল্ট্রি শিল্পে স্বচ্ছতা ও মান বজায় থাকবে।

২। কোম্পানির বাণিজ্যিক ও কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ডিম মুরগি উৎপাদন বন্ধ করা প্রয়োজন।

বড় কোম্পানিগুলোর কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি বর্তমানে প্রান্তিক খামারিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। এই কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থে বাচ্চা ও ফিডের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রান্তিক খামারিদের ক্ষতির মুখে ফেলে। বড় কোম্পানির কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এবং বাণিজ্যিকভাবে ডিম-মুরগি উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে বড় কোম্পানিগুলোকে ফিড এবং মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করতে হবে, আর প্রান্তিক খামারিরা ডিম এবং মুরগি উৎপাদন করবে। এর ফলে বাজারে স্বস্তি ফিরবে এবং খামারিরা ন্যায্যমূল্য পাবে।

৩। উদ্যোক্তা আইডি কার্ড প্রদান

প্রান্তিক খামারিদের জন্য উদ্যোক্তা আইডি কার্ড চালু করা উচিত, যাতে তারা সহজেই জামানতবিহীন ঋণ এবং অন্যান্য সরকারি সুবিধা পেতে পারেন। এটি তাদের ব্যবসা পরিচালনায় সহায়ক হবে এবং তাদের জন্য শক্তিশালী সমর্থন তৈরি করবে।

৪। বিশেষ ভর্তুকি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান

ফিড, বাচ্চা, বিদ্যুৎ, ওষুধ এবং অন্যান্য উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারী ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। এই ভর্তুকির মাধ্যমে খামারিরা লাভজনকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং তাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আসবে।

৫। প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ

প্রান্তিক খামারিদের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এটি তাদের উৎপাদন খরচ কমানোর কৌশল এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা শিখতে সাহায্য করবে, ফলে খামারিরা কার্যকরভাবে তাদের খামার পরিচালনা করতে পারবে।

৬। সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থা

বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব দূর করতে সরকারের কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা গঠন করা উচিত। পোল্ট্রি শিল্পের জন্য একটি স্বতন্ত্র বাজার ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে, যাতে বড় কোম্পানির একচেটিয়া দাম নির্ধারণের প্রবণতা বন্ধ হয় এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়।

৭। বাজারে স্বচ্ছতা এবং দামের স্থিতিশীলতা

পোল্ট্রি পণ্য, বিশেষত মুরগি এবং ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সরকারকে বাজারের দামের ওপর সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে দাম অত্যধিক না বাড়ে এবং খামারিরা ন্যায্য মুনাফা পেতে পারে।

৮। পোল্ট্রি উৎপাদন খরচের বৈষম্য দূরীকরণ

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এবং প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে উৎপাদন খরচের বৈষম্য দূর করতে হবে। বর্তমানে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি, যা তাদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। সঠিক এবং ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা উচিত।

৯। বড় কোম্পানির আধিপত্য কমানো

বড় কোম্পানিগুলো বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে রাখছে, যা প্রান্তিক খামারিদের জন্য ক্ষতিকর। সরকারকে একটি নীতি প্রণয়ন করতে হবে যা তাদের আধিপত্য সীমিত করবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে, যাতে খামারিরা তাদের উৎপাদনে লাভজনকভাবে টিকে থাকতে পারে।

১০। ফিড এবং বাচ্চার সরবরাহে স্থিতিশীলতা

ফিড এবং বাচ্চার সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো সংকট দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত যাতে খামারিরা তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ পেতে পারে এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে।

১১। পোল্ট্রি শিল্পের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন উদ্যোগ

পোল্ট্রি খামারিদের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে নতুন প্রযুক্তি, উন্নত পদ্ধতি এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। এটি তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি খামারের কার্যক্রমকে আরও লাভজনক করে তুলবে।

এই ১১টি দাবি বাস্তবায়ন হলে প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিরা সুষ্ঠু এবং লাভজনক ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং দেশের পোল্ট্রি শিল্পে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হবে। সরকারের উদ্যোগে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে, প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে লাভবান হতে পারবেন, ফলে দেশের পোল্ট্রি শিল্প আবার সুসংহত হবে এবং দেশের অর্থনীতি উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে।

মোঃ সুমন হাওলাদার
সভাপতি বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন