সাইদুর রহমান: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বয়স ৭৭ বছর। যিনি ১৯৬৩ সালে ছাত্র রাজনীতিতে জড়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। এমপি ছিলেন, মন্ত্রী হয়েছিলেন। বাবা মির্জা রুহুল আমিন সাবেক সংসদ সদস্য, চাচা মির্জা হাফিজ সাবেক মন্ত্রী,স্ত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা। দুই মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে শিক্ষকতায় আছেন। ফখরুল সাহেববদের মতো ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনা অর্থহীন।
জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যখন দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে, তখন মির্জা ফখরুল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে মির্জা ফখরুল বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে তিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির ৫ম জাতীয় সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের ২০শে মার্চ বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলওয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করার পর দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ঘোষণা করেন। ২০১৬ সালের ১৯শে মার্চ দলটির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে মির্জা ফখরুল মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন একজন রাজনীতিবিদ । ফ্যাসিবাদ শাসনামলে গত ১৫ বছরে ১১ বার কারাগারে গিয়েছেন। মামলা দুই শতাধিক। এই বয়সেও তার ওপর হামলা করা হয়েছিল। পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন বহু দিন। তিনি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বগুড়া-৬ আসন থেকে জয়ী হয়েও শপথ নেননি, এমন ঘটনার আগে কোন নজির নেই।
পতিত বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন, বিএনপি মুসলিম লিগ হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু মির্জা ফখরুল বিএনপিকে আরো শক্তিশালী করেছেন। দেশ এবং বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি এমন একজন রাজনীতিক যিনি বাবার জমি বিক্রি করে রাজনীতি করেন। যার বিরুদ্ধে ১/১১ সরকার তন্নতন্ন করে খুঁজেও দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। উনি বিএনপির ক্রান্তিলগ্নে দলের হাল ধরে দলকে ভাঙ্গনের মুখে পড়তে দেননি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একান্ত আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, ২০১২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সময়ে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট দাবিতে আমরা আন্দোলন করে আসছি। এরপর ছিল ডেমোক্রেসি নিয়ে আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আমরা বিভিন্ন কৌশল নিয়েছি। আন্দোলনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারা জন্য সকলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা যুগৎপথ আন্দোলন শুরু করি। সেখানে সবাই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে ডান-বাঁম সবাই ছিল। এটা আমাদের একটা সাক্সেস ছিল।
পরবর্তীকালে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী যে আন্দোলনটা করেছে, সেই আন্দোলনে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল কোটার পক্ষের আন্দোলন। এটা পরে টার্ন ইন্টু অ্যান্টি গর্ভমেন্ট। এই আন্দোলনটা দানা বেধেছে শেষের কয়েকটা দিন। তারা যে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গেছে, এটা কিন্তু কয়েকদিন। তিন আগস্ট তারা সরকার পতনের এক দফার ঘোষণা দেয়। তিন থেকে পাঁচের মধ্যে আন্দোলনটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেছে। এই যে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া, এটা তো একদিনে হয়নি। এটা দীর্ঘ আন্দোলনের ফলাফল।
মির্জা ফখরুল সাহেবের মতে, আমাদের দীর্ঘ ১৫ বছর যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এর মধ্যে আমাদের ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শুধু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে। আমাদের ২০ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে। এমপিসহ ৭০০-এর বেশি নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসনকে মিত্যা মামলায় অ্যারেস্ট করে জেলে দিয়েছে। অ্যাকটিং চেয়ারম্যান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের এমন একজন নেতা নেই, যাদের বিরুদ্ধে ৪০টা, ৫০টা, ৬০টা মামলা নেই। কিন্তু, এই জিনিসটাকে কিন্তু সবাই এখন উপেক্ষা করছে। এটাকে কেউ রিকগনাইস করছে না। এই ব্যাপারটা আমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমিসহ আমরা বহুবার জেলে গেছি। আমরা ১৫ বছর ধরে যুদ্ধটা করছি।
তার মতে, সংস্কারের প্রস্তাব তো আমাদের। ২০১৬ সালে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দেয়। এখন যে সংস্কারের কথা আসছে, তার প্রত্যেকটা রয়েছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপ্রতির ক্ষমতার ভারসম্য। দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, এর সবই আছে। এরপর আবার ২০২২ সালে যুগৎপথ আন্দোলনে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দীর্ঘ দুই বছর এটার ওপর কাজ করে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। যেটা সংস্কার। রাষ্ট্রের পরিবর্তনের রূপরেখা। এখন যারা বলছে, আমরা সংস্কার চায় না; তারা ওই ক্যাম্পেইনটা করছে বিএনপিকে একেবারে ম্লান করার জন্য। আমরা সংস্কার চাই। তবে, সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তো অসুবিধা নেই।
বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার লিবারেল ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি হিসেবে দেখতে চান মির্জা ফখরুল সাহেবরা। যেখানে আপনি আপনার মত প্রকাশ করতে পারবেন। তার জন্য আপনাকে কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হবে না। আপনি স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবেন। আপনি লিখতে পারবেন। সব স্থানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। মোটা দাগে সব অন্ধকার কাটিয়ে আমি শান্তিময় ও ভালোবাসাময় এক বাংলাদেশ দেখতে চান তিনি।
মির্জা সাহেবের এই ত্যাগ, নির্যাতন গণতন্ত্রের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য। সেই বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন নিয়ে পতিত হাসিনা সরকারের মতো অন্যরাও টালবাহানা করলে এই বয়সেও মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন না। গণতন্ত্রের জন্য তিনিতো লড়বেনই।
২৩ জানুয়ারি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিব এর নিরপেক্ষ সরকার এর দাবীর বিরোধিতা করে প্রমাণ করলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ থাকবে না। বিএনপির উদ্বেগ যৌক্তিক। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি অযৌক্তিভাবে বিএনপিকে আক্রমণ করে যাচ্ছে। এই দু’টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করলে প্রশ্ন উঠা কি স্বাভাবিক নয়? ইতিমধ্যে নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী জিয়াবাদ বা মুজিববাদ ঠেকানোর কথা বলে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপিকে তুলনা করে প্রকারান্তে হুমকি দিয়েছেন। নতুন দল গঠন করে নির্বাচন করবার কথাও বলেছেন। কিন্তু নতুন দলের কি নিবন্ধন নেয়া লাগবে না?
জাতীয় সরকার দীর্ঘ হবে এই আশঙ্কায় বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করতে রাজি হয় নাই, বিএনপি জাতীয় সরকার চেয়েছে নির্বাচনের পরে-এটি বিএনপির অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ। রাজনীতি সচেতন মানুষ সমর্থন করবে। বিএনপি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সরকার এর কথা বলে আসছে ২০২২ সাল থেকে। বিএনপি তার অবস্থানে স্থির আছে। এই দুটি বিষয়ে সামনে আসায় গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির কমিটমেন্ট আবারও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি ১/১১ -র নিষ্ঠুর ভিকটিম। বিএনপি আবার ১/১১ চায় নাহিদ ইসলাম এর এই মতামত শুনে মনে হচ্ছে সিরাজুদ্দৌলার আবারও পলাশী যুদ্ধ চায়।
বস্তুত বিএনপির নেতাকর্মী এবং মহাসচিব এর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজনের চেষ্টা তিনি করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির মহাসচিব যা বলেন সবই দলীয় বক্তব্য, তার একক বা ব্যক্তিগত মতামত না। দলের চেয়ারপার্সন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বক্তব্য দিলে মহাসচিব মহাসচিব এর পদে থাকতেন না। বিএনপিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জনগণের ভোটবিহীন একটি অনির্বাচিত জাতীয় সরকার গঠন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দুরভিসন্ধিমূলক পথে বিএনপি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে বিএনপির মহাসচিব এর প্রতি সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-নাগরিক কমিটির অনেকের ক্ষোভ দৃশ্যমান হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ম্লান করার ক্ষমতা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র এবং পরবর্তীতে গঠিত সরকারের চেয়ে বেশি কারও নেই। আপনারা যদি ভালো শাসন উপহার না দিতে পারেন, তাহলেই বলার সুযোগ তৈরি হবে যে আপনারা নিরপেক্ষ নন। আপনাদের ব্যর্থতাই আওয়ামী লীগকে ফিরে আসার পথ তৈরি করে দিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সংকট তৈরি হতে পারে। ছাত্র প্রতিনিধিরা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটিকে প্রথম থেকে সাধুবাদ জানিয়ে এসেছে বিএনপি।
বিএনপি আওয়ামী লীগকে নয় বরং সরকারের একটি অংশ তাদেরকে পুর্নবাসনের সুযোগ করে দিয়েছে। সাড়ে পাঁচ মাস বয়সী সরকার পুলিশ-প্রশাসন থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
সরকারের কর্মকান্ডে বিএনপি অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের কথা বললেই ছাত্ররা সহজভাবে নিতে পারছে না। এটি কি ফ্যাসিবাদী মানসিকতা নয়। একটি অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করলে নানা সংকটের উদ্ভব হয়। পরিস্থিতি সামাল দিন। বিএনপির মহাসচিবকে অহেতুক দোষারোপ না করে ভালো শাসন উপহার দেওয়ার নজর দিন। মানুষের কাজের ব্যবস্থা করুন, দ্রব্যমূল্য কমান, দরিদ্রদের সহায়তা করুন। দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। এভাবে প্রকাশ্য বিভাজন না করে নির্বাচন দিন, জনগনকে শান্তিতে থাকতে দিন।
লেখক : সাইদুর রহমান,
রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক,
দৈনিক ইত্তেফাক।