ফিরে দেখা-২০২৪ : বছরজুড়ে ব্যাংক খাতে আতঙ্ক

২০২৪ সাল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল একটি অত্যন্ত ঘটনাবহুল বছর। বছর জুড়েই এ খাত নানাবিধ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে। বছরের শুরুতে অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে ছিল রিজার্ভ-সংকট। ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ। চলমান এ সংকটে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় হুহু করে। এক যুগের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খেলাপি ঋণ, ব্যাংক ব্যবস্থার উপর সাধারন মানুষের আস্থার ঘাটতিÑ ইত্যাদি। ভেঙ্গে পড়ে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা। ঋণের নামে লুটপাট করা হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক মদদে ব্যাংকিং খাতে জন্ম দিয়েছে ঋণ খেলাপি। যাদের লুটতরাজ বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।


জুলাই পরবর্তী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে। ফলে অর্থনীতিও একটি বড় ঝাঁকুনি খেয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের চিত্র। আওয়ামী আমলে মহা লুটপাটের সাক্ষী দেশের ব্যাংকখাত। যার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত অর্থনীতির শ্বেতপত্রে। আতঙ্কিত গ্রাহকের আমানত তোলার চাপ ছিল বছরজুড়েই। দুর্বল ব্যাংকের জন্য টাকাও ছাপিয়েছেন নতুন গভর্নর। ব্যাংকখাত সংস্কারে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স।


১২ ব্যাংকের অবস্থা ‘খুবই খারাপ’, ৯টিতে জ্বলছে লাল বাতি। ৩টির অবস্থান ইয়েলো জোনে। ভালো আছে ১৬ ব্যাংক। সব মিলিয়ে ৩৮টি দুর্বল ব্যাংকের খবর গণমাধ্যমে ফাঁস হয় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেই। এরপর ১৪ মার্চ খেয়ে ফেলা পদ্মা ব্যাংকের বুকে আশার পাল উড়াতে চায় এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক শেষে আসে পদ্মা ও এক্সিমের একীভূত হওয়ার ঘোষণা।

২০০৯ সালে শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠনের পর, চলতি বছরে ব্যাংকটি আবারো একীভূতের আলোচনায় আসে। আতঙ্কে পড়েন ব্যাংকটির কর্মী ও আমানতকারীরা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ২১ জুলাই থেকে ৩দিন সাধারণ ছুটির কবলে পড়ে ব্যাংকখাত। ৫ দিন বন্ধ থাকার পর ২৩ জুলাই রাত থেকে ব্যাংকিং লেনদেন স্বাভাবিক হতে থাকে।

তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব পেয়েই, এস আলম গ্রুপের কব্জায় থাকা ৮টিসহ ১২টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভাঙেন ও পুনর্গঠন করেন। ব্যাংকখাতের সংস্কারে সেপ্টেম্বরেই গঠিত হয় ৬ সদস্যের টাস্কফোর্স। অক্টোবরের বড় খবর, লোকসানি পদ্মা ব্যাংককে টেনে তুলতে আসা এক্সিম নিজেই সাঁতরাচ্ছে লোকসানের নদীতে। সবশেষ ২৪ ডিসেম্বর ঘোষণা আসে একীভূত না হওয়ার।

২৮ নভেম্বর সংকটে থাকা ৬ ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর কথা জানান গভর্নর। যদিও দায়িত্ব নিয়ে দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছিলেন টাকা না ছাপানোর।

ব্যাংকখাতে লুটপাটের ফলাফল, সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির শ্বেতপত্রে জানানো হয়, এসব লুটপাটের পরিমাণ ২৪টি পদ্মাসেতু বা ১৪টি মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয়ের সমান।

এক বছরে দেশে ডলার সংকট ও তারল্য সংকট বেড়েছে। ব্যাংকগুলো খারাপ অবস্থায় পড়েছে, নতুন ঋণ অনুমোদনেও বাধা ছিল, খেলাপি ঋণ বেড়েছে অনেক। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট বেড়েছে। রিজার্ভ কমে গেছে। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে উভয় সংকটে পড়তে হয়েছে ব্যাংক ও গ্রাহকদের। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট কাটতে শুরু করেছে। নতুন বছর ব্যাংক খাতে সঙ্কট কেটে আলো আসবে এমনই প্রত্যাশা আমানতকারী ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের।

খেলাপি ঋণ:
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকখাত। জুলাই আন্দোলনের আগ পর্যন্ত নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা খেলাপিতে পরিণত করেছে নামধারী ব্যবসায়ি ও কিছু ব্যবসায়ি গ্রুপ। বার বার নিয়ম পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানো হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এ খাত। প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সে হিসেবে ২০২৪-কে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য খেলাপির ঋণের আসল চিত্র উন্মোচনকরণের বছরও বলা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রতি আমানতকারীদের আস্থা কমেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংক খাতের সংস্কার শুরু করেছে। ব্যাংক খাতের সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ সংস্কার অব্যাহত থাকলে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে আমানতকারীরা আবারো ব্যাংকের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এখন যা সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫ শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ হয়ে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। এ খেলাপি আগেই হয়ে আছে। এখন হিসাবে তা আসবে’। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকের জন্য, তথা অর্থনীতির জন্য এটা একটা বিরাট ধাক্কা। এ খেলাপি ঋণ একইসঙ্গে টাকার তারল্য এবং টাকার মানের ওপরে প্রভাব ফেলবে। দেশে টাকার তারল্য সংকটের সঙ্গে সঙ্গে, টাকার মানও কমবে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন:
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে এস আলমের দখলে থাকা ব্যাংকগুলোসহ দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টার হয়ে তারল্য সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নির্দেশনায় ১১টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরমধ্যে ১০টির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ। কিন্তু তাদের সংকট কাটেনি, বরং আরো অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, গ্রাহকরা এসযোগে তাদের আমানত তুলে নিতে আসে। কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাহকদের সারাদিন বসিয়ে রেখে টাকা না দিয়ে পরের দিন যেতে বলছে। এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এস আলমের দখলে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। এ ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ সাত হাজার ২৬৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের।
দায়িত্ব নেয়ার পর পরই গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ‘টাকা ছাপিয়ে ওই সব দুর্বল ব্যাংককে দেয়া হবে না। যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য আছে তাদের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। আর এর গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ তবে তাতে তেমন সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে টাকা ধার দিতে হয়েছে।

টাকা ছাপিয়ে ঋণ
আগের সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেয়া হবে না- গত আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পরই সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন মন্তব্য করেছিলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে তিন মাসের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেয়ার কথা জানান গভর্নর নিজেই। গভর্নর জানান, এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারবেন। যদিও সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, একদিকে যেমন টাকা ছাপানো হচ্ছে, তেমনি সেই টাকা বাজার থেকে তুলেও নেয়া হবে বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিকে ঠিক রাখার প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন না বলেও জানান গভর্নর।

ব্যাংক খাতে টাস্কফোর্স গঠন:
আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে এ টাস্কফোর্স। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণÑ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে ব্যাংক খাতের টাস্কফোর্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, টাস্কফোর্স মাধ্যমে সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিত করা, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করবে। এদিকে, ব্যাংকিং খাত সংস্কার টাস্কফোর্স থেকে ‘দ্য স্পেশাল রেগুলেশনস অব বাংলাদেশ ব্যাংকÑ ২০২৪’ নামে একটি নীতিমালা জারি হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিতে পারবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ মূল্যায়ন করে প্রকৃত মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বের করা এবং দুর্বল হওয়া ব্যাংকের অবস্থার উন্নয়ন করাই এই পরামর্শক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য।

তিন শতাধিক হিসাব জব্দ:
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিন শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এসব হিসাব জব্দ করে। তাদের হিসাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে। জব্দ করা হিসাবে লেনদেনের তথ্য গড়মিল পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি এবং দুদকে পাঠানো হয়েছে।

সালমান, নজরুল, এস আলমের পতন:
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতির দায়ে দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমানের পতন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত ১৬ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত এবং শেয়ারবাজার তছনছ করে দিয়েছেন তিনি ও তার বেক্সিমকো গ্রুপ। নিজের স্বার্থে ঋণ খেলাপির আইন পরিবর্তন করে তার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বৈধ করার চেষ্টা করেছেন। অপরদিকে, নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নজরুল মজুমদার দুবাই, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও সৌদিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। তিনি একাই প্রায় ১০ ব্যাংক নিজের কব্জায় নেন। করেন লুটপাট ও পাচার। নিজের পিএস, আত্মীয় ও ছেলেদের বসান দখলকৃত ব্যাংকগুলোয়। হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেন সাম্রাজ্য, বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিজ এলাকার ১০ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়োগ দেন ব্যাংকে, সরিয়ে দেন দক্ষ কর্মকর্তাদের। একইভাবে পতন হয়েছে সিকদার গ্রুপের। গ্রুপটির পরিচালক রন হক সিদকার ও রক সিকদারের হাতে প্রায় ধ্বংস হওয়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

ডলারের বিনিময় হার:
২০২৪ সালের শুরুতে ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের অস্থিরতা ছিল। বেশ কয়েকবার দামের পরিবর্তন করা হয়, সর্বশেষ জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৮ টাকা। ডলারের যোগান দিতে গিয়ে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ডলার বিনিময় হার বার বার পরিবর্তন হয়নি, অস্থিরতা অনেকটা কেটেছে। যদিও সম্প্রতি রেমিট্যান্সের ডলার রেট কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত দরে ক্রয় করেছে। এছাড়া পুরানো আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত দরে ডলার কিনছে। সেসব ব্যাংকগুলোর বিষয়ে খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং টিম।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পূর্বে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে দর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন রিজার্ভ তলানিতে নেমে যায়। অতর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমেছে। ২২ ডিসেম্বর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের বিপিএম হিসাব অনুযায়ী তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে এখন রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের ওপরে রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের ধস নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ছিলেন। সেখান থেকে এখন ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেটাই বড় বিষয়। এখন আর এগুলো পড়ে যাবে না। তিনি আরো বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে কতগুলো সংকট ছিল। বৈশ্বিক বাণিজ্য আমাদের বিশাল ঘাটতি ছিল। রিজার্ভের পতন হচ্ছিল। এই জায়গা থেকে আমরা অনেকটুকু বের হয়ে এসেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ আর কমছে না। গত আগস্ট মাসের পরে বাংলাদেশ ব্যাংক কোন ডলার বিক্রি করেনি। কাজেই আমাদের রিজার্ভ কমবে না, বাড়বেই। রেমিট্যান্সের বিরাট প্রবাহ পরিবর্তন হয়েছে। গত পাঁচ মাসে আমাদের ৩ বিলিয়ন অতিরিক্ত রেমিট্যান্স এসেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অর্থের পাচার কমে গেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ:
গণমাধ্যমের কাছে বারবার অস্বীকার করলেও অবশেষে গত জুলাইয়ের শুরুতেই নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের হিসাব স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার যা গোপন করে আসছিলেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

রেমিট্যান্স প্রবাহ:
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ভাটা পড়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সেই রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটাই বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে দেশে এক হাজার ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুলাইয়ে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি টাকার নিচে আসলেও আগস্ট থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বর মাসের ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। গভর্নর ড. মনসুর বলেছেন, গত পাঁচ মাসে আমাদের ৩ বিলিয়ন অতিরিক্ত রেমিট্যান্স এসেছে।

গভর্নরকে বয়কট:
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য বয়কট করেছিলেন সাংবাদিকরা। যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বিরল ঘটনা। রীতি অনুযায়ী বাজেট ঘোষণার পরের দিন সংবাদ সম্মেলন করেন অর্থমন্ত্রী। সাধারণত বাজেটোত্তর এ সংবাদ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের। ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্ট, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন তিনি। তবে এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকরা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে বয়কটের ঘোষণা দেন।

১২তম গভর্নরের পলায়ন:
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ত্যাগের পর তিনদিন দায়িত্বে থাকলেও অফিস করেননি সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে শুরু হয় নানা মুখরোচক গুঞ্জন। এরপর চতুর্থ দিন ৯ আগস্ট দুপুরে অনলাইনে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এক রকমের লাপাত্তা ছিলেন, করেননি অফিস, দেখা যায়নি লোক-সম্মুখে। একইভাবে অফিস করলেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দুই ডেপুটি গভর্নর ও পলিসি উপদেষ্টা। নিয়োগ দেয়া হয় দুইজন ডেপুটি গভর্নর।

মরিয়ম সেঁজুতি