ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষামূলক আর মার্চে বাণিজ্যিকভাবে অপারেশনে যাবে চট্টগ্রাম-ঢাকা তেলের পাইপলাইন। পাইপলাইনটি জ্বালানি তেল পরিবহনে অপচয় রোধসহ অনেকদিক থেকে স্বস্তি নিয়ে আসবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান।
তিনি বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো। পাইপলাইনটি চালু হলে তেলের নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি লাইটারেজে করে আনার ক্ষেত্রে খরচ ও অপচয়ের বিষয়টিও থাকছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাইপলাইনটি দিয়ে ডিজেল আনা হবে। আমাদের ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ৭০ শতাংশ। সেই চাহিদা সরবরাহ নিশ্চিত হয়ে যাবে। পেট্রোল ও অকটেন আগে যেভাবে সরবরাহ করা হতো, কখনও রেলওয়ে ওয়াগনে করে, কখনও নদীপথে ট্যাংকারে করে, সেভাবেই আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, রেলে করে তেল আনতে অনেক রকম সমস্যা পোহাতে হয়। যথা সময়ে লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) পাওয়া কঠিন হয়। গত সপ্তাহেও লোকোমোটিভ পাওয়ার জন্য খোদ রেলওয়ে সচিবের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম তেলের পাইপলাইনের জন্য ২০১৭ সালে প্রাক সমীক্ষা করা হয়। শুরুতে মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু কাজ শুরুই হয় ২০২০ সালে। প্রথম দফায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর, দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ হয়। ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া আরও ৬ মাস প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। বিপিসির এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। কোম্পানিটির সাফল্যের পর ঝুলে থাকা (নারায়ণগঞ্জ-এয়ারপোর্ট) জেট ফুয়েলের পাইপলাইনের কাজও তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিপিসি অর্থায়নে গৃহীত এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ২৩৭ কিলোমিটার, কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার, ফতুল্লা হতে থেকে গোদনাইল ডিপো পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। পাইপলাইনটি চালু হলে বছরে ৬৫ কোটি টাকা পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে বলে আশা করছে বিপিসি। খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি নানা রকম জটিলতা দূর হয়ে যাবে।
নদীপথে লাইটারেজে করে পরিবহনকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল সিন্ডিকেট বিদ্যমান। গোদনাইল ডিপো তেল চুরির জন্য স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। সেই চুরিকে জায়েজ করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো লাইটারেজ থেকে তেল খালাশের সময় অপচয় বলে। পাইপলাইন হয়ে গেলে সেই বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছে বিপিসি।
প্রকল্পটি ঠেকিয়ে রাখতে তেল পরিবহনকারী লাইটারেজ মালিকরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিলেন এক সময়। তাদের কারণেই অনেকটা ধীর গতি লক্ষ্যণীয়। আবার তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তেল চুরির সিন্ডিকেটের লোকজনও। অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে পাইপলাইনটি।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, সেচ মৌসুম নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে কোনো রকম সমস্যা হবে না। প্রাক্কলিত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের পরিবেশকদের কনফারেন্স করা হচ্ছে। সেটিও সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে।
দেশের শষ্যভান্ডার খ্যাত উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থা ছিল খুবই জটিল বহুঘাট ও হাত ঘুরে। লাইটারেজে করে তেল নেওয়া হতো বাঘাবাড়ি, সেখান থেকে ট্যাংকলরী, আরেকটি রুট হচ্ছে রেলওয়ের মাধ্যমে পৌঁছানো। এখন সেখানেও পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ পাইপলাইন। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্ন, দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে জ্বালানি সরবরাহের জন্য ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ পাইপ লাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩১.৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের সময়কাল ছিল ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ের আগেই পাইপলাইনটি চালু হয়েছে। ভারতের নুমালীগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপো পর্যন্ত বিস্তৃত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানি করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০৩০ সালে ৯৩ লাখ টনের প্রাক্কলন করা হয়েছে, এরমধ্যে ৬৭.১৯ শতাংশ ডিজেল।বাংলাদেশে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে না, গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে প্রাপ্ত কনডেনসেট থেকে পেট্রোল এবং ৪০ শতাংশের মতো অকটেন যোগান আসে। বিপুল পরিমাণ ডিজেলসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করে যোগান দেওয়া হয়। বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করা হয় নদীপথে। কিন্তু নদীবন্দরগুলোতে নাব্যতার অভাবে বড় জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারে না। তাই নির্ভর করতে হতো লাইটারেজ জাহাজের ওপর।