বঞ্চিত সাড়ে চার হাজার কর্মকর্তার আবেদন

আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কর্মকর্তা প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদনগুলো জমা পড়েছে। আবেদনকারীদের মধ্যে বঞ্চিত মৃত কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা ওই কর্মকর্তার পক্ষে আবেদন করেছেন। সুপারসিড হওয়া সিনিয়র সচিব ও সচিবদের আবেদনও পাওয়া গেছে। সব কর্মকর্তার কমন দাবি-তারা সিনিয়র অথবা সচিব হতে পারতেন। ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা এবং ব্যাচের সহকর্মীদের রোষানলে পড়ে তারা কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি পাননি। তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে তারা মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং আর্থিক সুবিধা ফিরে পেতে চান। আবার অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতিসহ চাকরিতে ফিরতে আবেদন করেছেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা যায়, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদনের সময় ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনের সময় বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কর্মকর্তারা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে যতটা দুষছেন, এর চেয়ে বেশি দুষছেন নিজ ব্যাচের কিছু সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাকে। তারা বলছেন, বিগত সরকারের সময় সিন্ডিকেট করে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হতো। এর সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত নানাভাবে বঞ্চনায় শিকার হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। ১৬ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই কমিটি অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশসহ মতামত দেবেন। চাইলে কোনো কোনো ‘কেসে’ তাৎক্ষণিক মতামতও দিতে পারবে কমিটি। কমিটির সুপারিশের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগের একজন করে অতিরিক্ত সচিব কমিটিতে আছেন। এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিবকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কমিটিতে কো-অপ্ট সদস্য হিসাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এসিআর, শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের কর্মকর্তারা আছেন। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের প্রতিটি আবেদন যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে। যাদের এসিআর নিয়মিত ছিল না, শৃঙ্খলাসংক্রান্ত ও দুর্নীতির মামলা ছিল এবং সে কারণে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন-এমন আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সব তথ্য নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্যেকের এসিআর, শৃঙ্খলা এবং দুর্নীতির বিষয়গুলো আমলে নেওয়া হচ্ছে। যাদের আবেদন সঠিক, তাদের বিষয়ে একধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বিষয়ে সরকার উদারভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে হেয় করা হয়েছে। তিনি নিজেও বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসাবে উল্লেখ করে সিনিয়র সচিব বলেন, পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার কারণে সামাজিক ও আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তাছাড়া দিন শেষে টাকা একটি বড় বিষয়। জীবন চলার জন্য টাকা খুবই জরুরি।

এ সিনিয়র সচিব আরও বলেন, কমিটির সুপারিশের আলোকে বঞ্চিতদের মধ্যে যাদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আছে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। কর্মসংস্থান দেওয়ার মতো সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। আবার অনেকে আর্থিক সুবিধা পাবেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদন পড়েছে। তবে এ সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। কিছু আবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে জমা নেওয়া হয়েছে। কিছু আবেদন অনলাইনে জমা পড়েছে এবং কিছু আবেদন বিদেশে থাকা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অনলাইনে পাঠিয়েছেন। সব আবেদন তালিকাভুক্ত করার কাজ চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরের পর মারা গেছেন এমন কর্মকর্তাদের পরিবারও আবেদন করেছে। নিয়ম অনুসারে অন্য ১০ কর্মকর্তার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হবে, তারাও সেই সিদ্ধান্তের আওতায় আসার দাবি করেছেন। অনেক পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, বঞ্চিত হওয়ায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।

আবেদনে অধিকাংশ সিনিয়র সচিব দাবি করেন, ব্যাচে মেধা তালিকায় নিচের দিকের কর্মকর্তাকে আগে সচিব ও সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। সুতরাং তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অবসরে যাওয়া সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের করা আবেদনে দাবি করা হয়, চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে মাত্র কয়েক মাসের জন্য তাকে সচিব করা হয়েছে। সময়মতো পদোন্নতি না দেওয়ায় সিনিয়র সচিব হতে পারেননি। তিনি সিনিয়র সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং একই সঙ্গে আর্থিক সুবিধা দাবি করেছেন।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের নবম ব্যাচের কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ। তিনি নিলফামারী জেলার (জেলা প্রশাসক) ডিসি ছিলেন। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মেধা তালিকায় তার অবস্থান ষষ্ঠ। পাঁচবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে তিনি অবসরে গেছেন যুগ্মসচিব হিসাবে। তিনি প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা কাজী আনোয়ারুল হাকিম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি গাইবান্ধা জেলার ডিসি ছিলেন। বিসিএস ৮৫ ব্যাচের ২৬ ক্যাডারের কম্বাইন্ড মেরিট লিস্টে তার অবস্থান প্রথম ১০০ জনের মধ্যে। নিজ ক্যাডারে (প্রশাসনে) তার অবস্থান প্রথম ১০ জনের মধ্যে। কিন্তু বিধি বাম, ২০০৭ সাল থেকে ছয়বার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে সপ্তমবারে যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৭ সালে। অর্থাৎ তার ব্যাচম্যাটরা যখন সচিব, তখনও তিনি উপসচিব হিসাবে তাদের অধীনে কাজ করেছেন। যুগ্মসচিব হিসাবে অবসরে যাওয়া এ কর্মকর্তা প্রতিকার চেয়ে অবেদন করেছেন। তিনি সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতিসহ আর্থিক সুবিধা দাবি করেছেন।

বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম। আওয়ামী লীগ আমলে সিলেটের ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক এক সিনিয়র সচিবের কারসাজির কারণে সচিব হিসাবে পদোন্নতি পাননি বলে তিনি যুগান্তরকে জানান। অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসরে যাওয়া এ কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব, সচিবসহ যথাযথভাবে মূল্যায়নের দাবি করেছেন। একই ব্যাচের কর্মকর্তা মুহাম্মদ নুরুল আলম। তার আইডি নং ৩৪০২। পিএসসির মেধা তালিকায় তার অবস্থান ৫৪। তিনি পাঁচবার বঞ্চিত হয়ে ষষ্ঠবারে যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এরপর তার আর কোনো পদোন্নতি হয়নি। তিনি ভূতাপেক্ষভাবে সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতিসহ অর্থিক সুবিধা দাবি করেছেন। বিসিএস ৮৪ ব্যাচের যুগ্মসচিব মেহের নিগার প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। মেধা কোটায় চাকরি পাওয়া এ কর্মকর্তার দাবি, তাকে দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি পদোন্নতি, আর্থিক সুবিধাসহ হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে আবেদন করেছেন। বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব মো. রুহুল আমীন বলেন, ব্যাচের মেরিট লিস্টে যাদের অবস্থান, তার নিচের দিকে এমন ২১ জনকে সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করা আবেদনেও তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি সিনিয়র সচিব ও সচিব হিসাবে পদোন্নতিসহ আর্থিক সুবিধা দাবি করেছেন। অষ্টম বিসিএসের কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলাম। সচিব ও সিনিয়র হিসাবে পদোন্নতির আবেদন করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যত নিয়মকানুন করেছে তার প্রতিটি ভেঙ্গেছে। বিশেষ করে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি পদোন্নতিবঞ্চিত হন, তাহলে তিনি কেন বঞ্চিত হলেন, এর কারণ জানাতে হবে। কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল, তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানার অধিকার রাখেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিষয়ে কাউকে কিছুই জানানো হয়নি। তিনি সিনিয়র সচিব, সচিব পদে পদোন্নতি এবং আর্থিক সুবিধার জন্য আবেদন করেছেন। বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা আবি আব্দুল্লাহ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কী কারণে ৭ বার পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলো, তা জানতেই পারিনি। উপসচিব হিসাবে অবসরে যাওয়া এ কর্মকর্তা কাউকে দায়ী করছেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনে শুধু ইনসাফের ভিত্তিতে ফয়সালা দাবি করেছেন।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ একটি মহৎ কাজ। দেরিতে হলেও তারা হারানো সম্মান ফিরে পাবেন। সিনিয়র সচিব ও সচিবদের আবেদনের বিষয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, তারা বঞ্চিত হলে আবেদন করতেই পারেন। কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। মৃত কর্মকর্তাদের পরিবারের আবেদনও যৌক্তিক। তিনি আরও বলেন, আমার মতে, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়া যাদের পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তবে দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ কিংবা দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত অথবা যাদের এসিআর খারাপ হওয়ায় পদোন্নতি পাননি, তাদের বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকির পরামর্শ দেন।