ইসলামী ব্যাংক দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তি এমডি হতে মরিয়া

#দুদকে রয়েছে একাধিক মামলা

ইসলামী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির দুদকের মামলার আসামী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান এমডি (চলতি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ব্যক্তিকে ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই সাক্ষাৎকারে ডেকেছেন। এতে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদশে ব্যাংক একদিকে সুশাসন চাইবে, আরেক দিকে অপরাধী ব্যক্তিকে পদে বসানোর জন্য সুপারিশ করবে। এটা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। তারা বলেন, একই মামলায় সাবেক এমডি মনিরুল মওলা কারাগারে। আরেক জন এমডি পদে কিভাবে দায়িত্ব পালন করেন? তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসন কোথায় থাকে?
আওয়ামীর লীগের গোটা শাসনামলে ব্যাংক লুটপাটের মূল নায়ক এস আলম গ্রুপ ও নাসা গ্রুপ এবং নাবিল গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এই গ্রুপগুলো। সেই সব ঋণের সহযোগী ছিলেন সাবেক এমডি মনিরুল মওলা ও ওমর ফারুক খানসহ বেশ কিছু কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির এক সার্কুলারে দেখা গেছে, কোনো ফৌজদারি আদালত কর্তৃক দণ্ডিত নন কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যবিধ অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত নন এমন ব্যক্তিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অপরাসণ বা দুর্দীতির দায়ে বহিষ্কার হলে তাকে এমডি পদে নিয়োগে যোগ্য হবে না। এছাড়া এমডির পূর্ববর্তী পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর অর্পিত কার্য সম্পাদনের প্রমাণ ও সুনাম থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে ওমর ফারুক খান দুদকের একাধিক মামলার আসামী। তার বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি ইসলামী ব্যাংকের দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তি। তাহলে সেই ব্যক্তি কিভাবে ইসলামী ব্যাংকের এমডি হওয়ার যোগ্য প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খানকে এমডি পদে নিয়োগ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ঋণ- জালিয়াতির অভিযোগের পাশাপাশি দুদকে একাধিক মামলাও রয়েছে। একই মামলায় সাবেক এমডি মনিরুল মওলা কারাগারে রয়েছে। সেখানে তাকে কিভাবে এমডি পদে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োগের সুপারিশ করে। একদিকে সুশাসন চাইবে, আরেক দিকে অপরাধী ব্যক্তিকে পদে বসানোর জন্য সুপারিশ করবে। তাহলে তো সুশাসন ফিরে আসবে না।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। শেখ হাসিনার আমলে দখল, ঋণ কেলেঙ্কারি আর লুটপাটে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ব্যাংক খাত। আওয়ামীর লীগের গোটা শাসনামলে ব্যাংক লুটপাটের মূল নায়ক ছিলো এস আলম গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকসহ প্রায় আটটি ব্যাংক গ্রুপটি দখলে নেয়। এসব ব্যাংক দখলে নেওয়ার পর থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় তারা। শুধু ঋণ নয়, এসব ব্যাংকের মালিকানা নিজেদের কব্জায় রাখতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে শেয়ার নিয়েছে প্রভাবশালী গ্রুপটি।
ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলে নেওয়ার পরই শুরু হয় নামে-বেনামে টাকা বের করার আয়োজন। এ জন্য আগে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের মধ্যে নিজস্ব একটি অনুগত বাহিনী গড়ে তোলে এস আলম। প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় শাখায় নিজের অনুগতদের বসানো হয়।
ব্যাংক সূত্র জানা যায়, সাইফুল আলম (এস আলম) ছিলেন মনিরুল মওলামের গডফাদার। তিনি তার গ্রুপসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংক থেকে লোপাট করেছেন। মনিরুল মওলার স্থানে বসানোর প্রক্রিয়া চলা ওমর ফারুকের গডফাদারের নাম নজরুল ইসলাম মজুমদার। মজুমদারের ঋণ মূলত দেয়া হয়েছে ব্যাংকটির লোকাল শাখা থেকে। এ শাখায় ম্যানেজার হিসেবে ইভিপি মো. ওমর ফারুক খান যোগদান করেন। মজুমদারের নাসা গ্রুপের বেশির ভাগ ঋণ তার মেয়াদকালেই দেয়া হয়েছে। পরবর্তী ছয় বছরে ২টি পদোন্নতি নিয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হন ওমর ফারুক খান। ২০২৩ সালের ইসলামী ব্যাংক থেকে দুর্দীতির দায়ে তাকে বহিষ্কার করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর আবার ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেন নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা এই কর্মকর্তা ওমর ফারুক।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম, এমডি মনিরুল মওলা এবং ওমর ফারুকসহ বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে একাধিক মামলা রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, ‘ ইসলামী একটি ”আদর্শিক ব্যাংক”। আওয়ামী লাগের আমলে যারা এই ব্যাংকে লুটপাট করেছে। তারাই যদি আবার ব্যাংকের হাল ধরে, তাহলে তো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি সুনামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি এমডি হলে ব্যাংকের সুনাম নষ্টে হয়ে যাবে।’
এব্যাপারে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি চলতি দায়িত্ব) ওমর ফারুক খানের সাথে হোয়াটস্যাপে যোগাযোগ করা হলে কল ধরেননি।