বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার হালনাগাদকরণে এসএমই ফাউন্ডেশনের নীতি সংলাপ

সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে ট্রেড লাইসেন্সের শর্ত শিথিল, অস্থাবর সম্পত্তিকে সহায়ক জামানত হিসেবে বিবেচনা, জামানতবিহীন ঋণকে উৎসাহ দেয়ার পরামর্শ ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের

সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে ট্রেড লাইসেন্সের শর্ত শিথিল, অস্থাবর সম্পত্তিকে সহায়ক জামানত হিসেবে বিবেচনা, জামানতবিহীন ঋণকে উৎসাহ দেয়াসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাগণ। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান অর্থায়ন নীতিমালা অধিকতর উদ্যোক্তাবান্ধবসহ হালনাগাদকরণ বিষয়ে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের অংশগ্রহণে এক নীতি সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব কথা উঠে আসে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিবৃন্দ সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে তাদের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, ঋণ প্রদানকালে ট্রেড লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতার শর্ত শিথিলকরণ, কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইনান্সিং স্কিমের সুদের জন্য পৃথক স্প্রেড (উদ্যোক্তা ও ব্যাংক পর্যায়ে ঋণের সুদের হারের ব্যবধান) ও প্রভিশনিং চালুকরণ, ভেল্যুচেইন খাতকে ট্রেডিং হতে পৃথকীকরণ, ক্লাস্টারভিত্তিক লিড ব্যাংক নির্ধারণ, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বিষয়ে অস্পষ্টতা দূরীকরণ, সহায়ক জামানত হিসেবে অস্থাবর সম্পত্তিকে বিবেচনায় আনা, জামানতবিহীন ঋণ প্রদানে উৎসাহ দান, এসএমই ঋণে ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রচলন, কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের ঋণের প্রভিশনিং পৃথকীকরণ, রি-ফাইনান্সিং স্কিমগুলোকে পূনঃমূল্যায়ন করা, উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান বা কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব ক্যাটাগরির ভিত্তিতে অর্থাৎ গ্রিন/ইয়োলো/রেড ক্যাটাগরিতে সংজ্ঞায়ন করে অর্থায়ন এবং সে অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ করা, ফিশারিজ/পোল্ট্রি/ডেইরি উদ্যোগসমূহকে এসএমই ঋণের আওতাভূক্ত করা, ব্যাংকগুলোর বার্ষিক মুনাফা হতে সিএসআর খাতের তহবিলের একটি অংশ সিএমএসএমই খাতে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ সারাদেশে উদ্যোক্তা নিয়ে কাজ করে এ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যেমন- বিসিক, জয়িতা ফাউন্ডেশন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা অধিদপ্তর, জেলা চেম্বার, সেক্টরাল অ্যাসোসিয়েশন, নারী-উদ্যোক্তা সংগঠন ইত্যাদিকে সংশ্লিষ্ট/সংযুক্ত করে, তাদের ভূমিকা স্পষ্ট করে এবং ঋণ বিতরণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে এসব সংস্থার সাথে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার। এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তাফা ।অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান এবং পলিসি ডায়লগের প্রেক্ষাপটের ওপর উপস্থাপনা প্রদান করেন ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজিম হাসান সাত্তার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তাফা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কল্যাণে কাজ করছে। বিদ্যমান মাস্টার সার্কুলার হালনাগাদকরণে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত নীতি সংলাপে প্রাপ্ত যৌক্তিক সুপারিশসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করবে মর্মে আশ্বস্ত করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ মাস্টার সার্কুলার হালনাগাদকরণে নীতি সংলাপ আয়োজনের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাবান্ধব ব্যাকিং খাত গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুপারিশসমূহের আলোকে মাস্টার সার্কুলার হালনাগাদ করা হলে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাগণ ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আরো বেশি উপকৃত হবে।

উন্মুক্ত আলোচনায় প্রতিনিধিবৃন্দ এসএমই ফাউন্ডেশনের সুপারিশসমূহ অন্তর্ভুক্ত হলে সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলে মতামত প্রদান করেন। নীতি সংলাপ অনুষ্ঠানে এসএমই উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এসএমই সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনে, ফিনটেক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, দাতা সংস্থা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

এ যাবত এসএমই ফাউন্ডেশনের ক্রেডিট হোলসেলিং কর্মসূচির আওতায় ১০ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ পেয়েছেন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৩২% শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র সবশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, দেশে ৭৮ লাখের বেশি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯৯%-এর বেশি। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫% এসএমই খাতে। এই খাতে প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি জনবল কর্মরত আছে। অধিক জনসংখ্যা এবং সীমিত সম্পদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এমএসএমই একটি শ্রমনিবিড় ও স্বল্প পুঁজিনির্ভর খাত। উৎপাদন সময়কাল স্বল্প হওয়ায় জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এমএসএমই অবদান অনেক। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সিএমএসএমই খাতের বিকাশ ও উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে এসএমই ফাউন্ডেশন অনুঘটকের ভূমিকা রাখছে। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সুরক্ষার মাধ্যমে এসএমই খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশন সরকারের জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ এসএমই নীতিমালা ২০১৯ এবং এসডিজি ২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা এসএমই ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কর্মসূচির সুবিধাভোগী প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা।