বাজার রেগুলেট করাই বিএসইসির কাজ: রাশেদ মাকসুদ

পুঁজিবাজারের সূচক ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করা নয়, বরং বাজারকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নীতিমালা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের দিকেই নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এমন মন্তব্য করেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি বলেন, বাজারের সূচক উঠানো-নামানো আমাদের দায়িত্ব না। বিএসইসির মূল কাজ হলো বাজার রেগুলেট করা, নীতিমালা তৈরি করা এবং তা কাজ করছে কি না, তা মনিটরিং করা।


বুধবার রাজধানীতে ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনায় অন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী, অর্থ) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইসিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ, ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, সিডিবিএল চেয়ারম্যান তপন চৌধুরী এবং এফআইসিসিআই সভাপতি জাভেদ আক্তার।

আরও পড়ুনঃ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে অনেকে সর্বস্বান্ত: তপন চ‍ৌধুরী

পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের অন্যতম স্তম্ভ হলো মিউচুয়াল ফান্ড। কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রভাব খুবই কম। কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা জানি। এখন একটি টাস্কফোর্স এসব নিয়ে কাজ করছে। খন্দকার রাশেদ মাকসুদ আরো বলেন, আমরা একটি ভগ্ন প্রক্রিয়ার অর্থনীতি থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। গত ৯ মাসে যেভাবে অর্থনীতির কান্ডারিরা জাহাজ ঘুরিয়ে আনতে পেরেছেন, সেটিই বড় অর্জন। পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনী অনেক কোম্পানি অতিরিক্ত মূলধনের দাবি দেখিয়ে বাজার থেকে বিপুল অর্থ তুলে নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, শুধু বিএসইসি নয়, এই বাজারের পেছনে আরও তিনটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব আছেথ আইডিআরএ, এফআরসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তিন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ছাড়া শেয়ারবাজারে সুশাসন আনা কঠিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমাদের এখানে যেসব আলোচনা হয়েছে সেগুলো আমি লিখিত আকারে দিতে বলেছি। কারণ আমরা অনেক সময় শুনি শুধু কথাই আর কাজ হয় না। এজন্য সবগুলো কাজের বিষয় আমি লিখে নিয়ে সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। গত ১৫ বছর যে ঝঞ্জাট হয়েছে সেগুলো পরিষ্কার করা খুব দূরহ ব্যাপার। তবে দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছি সেহেতু আমরা কাজ করছি।পুঁজিবাজারকে মেইনস্ট্রিম অর্থনীতির সাথে মেলায়নি বিগত সরকারগুলো।

ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, আমি যেদিনই ডিএসইতে কথা বলি সেদিনই দেখি ইনডেক্স ৩০ থেকে ৪০ পয়েন্ট নেই। তবে আজকে দেখতে পাচ্ছি ইনডেক্স পজিটিভ আছে। এই সময়ে সুদের হার বেশি হওয়াতে সবাই মার্কেট থেকে টাকা সরিয়ে ট্রেজারি মার্কেটে যাচ্ছে এবং বন্ড মার্কেটে যাচ্ছে। পাকিস্তানে টোটাল ট্রেডের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে সরকারি সিকিউরিটিজ।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আমাদের মানসিক সান্তনা দরকার। বিএসইসি চেয়ারম্যানকে আমরা সামনে দেখলেই বাজার ভালো হবে। অবশেষে আমাদের চেয়ারম্যান আমাদের সামনে এসেছে এবং বাজারও ভালো হতে শুরু করেছে। আমাদের ব্রোকারদের পক্ষ থেকে দাবি ছিল এআইটি ৫ পয়সা থেকে কমিয়ে আনা আপনি সেটা ৩ পয়সায় এনেছেন যা ১৫ বছরে কেউ আনতে পারেনি। আমাদের সিসিএ যে কমিশন ছিল সেটা নিয়ে দীর্ঘদিন ভোগান্তিতে ছিলাম সেটাও ব্রোকারদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আপনারা শুধু আমাদের পাশে থাকুনÑ আমরা এটাই চাই।

আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে হলে ভালো মানের কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসতে হবে। ভালো কোম্পানি ছাড়া শেয়ারবাজার দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ দেবো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুস বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সাথে বাজারের উন্নয়নে বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ওই বৈঠকে যে সমস্ত দিক নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো বাস্তবায়ন হলে মার্কেট স্থিতিশীল হবে। তিনি আরো বলেন, বন্ডের সুদ বাড়ানো হয়েছে, যেকারণে বিনিয়োগকারীরা সেদিকে যাচ্ছে। মার্কেট থেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিচ্ছেন তারা। তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বন্ডের সুদ কমাতে হবে। আবু আহমেদ বলেন, দেশের বৃহত্তর অর্থনীতির সার্থে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে হবে। আইসিবিকে নিয়ে তিনি বলেন, আইসিবি’কে বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হচ্ছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি আর চলতে পারছে না। টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে। আইসিবি চেয়ারম্যান বলেন, শুধু মুনাফার কথা ভেবে নয়, জনগণের স্বার্থ ও সরকারের আর্থিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনা করেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বিপুল মুনাফা করে, যা দেশের শীর্ষ চারটি ব্যাংকের সম্মিলিত মুনাফার চেয়েও বেশি। অথচ ব্যাংকটি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। অথচ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বাজারে এটি তালিকাভুক্ত। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব বহুজাতিক কোম্পানি দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হবে না, তাদের ওপর অতিরিক্ত আয়কর আরোপ করা উচিত। শেয়ারবাজার স্থবির অবস্থায় রয়েছে উল্লেখ করে আবু আহমেদ বলেন, বাজার গতিশীল না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো উচ্চ সুদহার। এর প্রভাব বিনিয়োগে পড়ছে, বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হচ্ছে।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) চেয়ারম্যান তপন চৌধুরী বলেন, অনেক বিনিয়োগকারী সারাজীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছেন। দেশের অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারে তাদের অনেকেই বিনিয়োগ হারিয়েছেন, সর্বশান্ত হয়েছেন। এই ধরনের পরিস্থিতি আগামীতে যেন না হয় সে বিষয়টি সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। মার্কেটের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। আশা করি পরবর্তী সরকার সেগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করবে।

তপন চৌধুরী বলেন, অনেক বিনিয়োগকারী কোম্পানির ব্যালেন্স শিট বুঝতে পারেন না। তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। এ সময় তিনি বলেন, টাকা না লাগলে কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে চাইবে না। শেয়ারবাজারে আসার সময় যারা আমাদের স্কয়ার ফার্মার শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের স্যামসন এইচ চৌধুরী স্কয়ার টেক্সটাইলের শেয়ার বিনামূল্যে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বাধা দেয়। এরপর স্যামসন চৌধুরী উচ্চ আদালতে মামলা করে সেই শেয়ার বিতরণ করেন। তিনি বলেন, আমাদের ৯০ কোটি টাকার কোম্পানি ছিল। কিন্তু এখন শুধু স্কয়ার ফার্মার মার্কেট ক্যাপ ১৮ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের অবদান অনেক। এ কারণে আমার বাবা স্যামসন চৌধুরী বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার কথা বলে গেছেন।

এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ