বাড়ছে নারীর নিরাপত্তাহীনতা

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অনেকটাই দৃশ্যমান। ছিনতাই, ডাকাতি, লুটপাট, হামলা ছাড়াও ঘটছে মব সহিংসতার মতো ঘটনা। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর পড়লেও নারীদের নিরাপত্তাহীনতার বহুমাত্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে গত কয়েক মাসের নানা ঘটনায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি আগেও ছিল।
তবে বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সেই সঙ্গে একটি বিশেষ গোষ্ঠী নারীদের দমিয়ে রাখতে পুরুষতান্ত্রিক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও মত দেন তাঁরা।
বাড়ছে নারীর নিরাপত্তাহীনতাএমন পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন/নারী ও কন্যার উন্নয়ন।

’ দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত বছর ডিসেম্বরে দেশে এক হাজার ২০৫টি মামলা হয়েছে। আর একই কারণে চলতি বছর জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি। অর্থাত্ এক মাসের ব্যবধানে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেড়েছে ১৯.৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ২০৫ ও ১৮৯টি। মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক তথ্যে বলা হয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১১টি। জানুয়ারিতে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০টি। এ দুই মাসে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত তিনজন নারী।

যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৮টি। এই দুই মাসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩৬ জন নারী। বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৯৫ জন নারী ও কন্যাকে। মহিলা পরিষদ দেশের ১৫টি গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন মাসে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ক্রম-ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যানুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২৪১টি। চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা যথাক্রমে ২৭১ ও ২৯৫-এ দাঁড়িয়েছে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৯টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩২টি। যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৪৫টি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছর জানুয়ারিতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ১১ জন নারী। জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ১৮টি। ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে দুটি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি। এর মধ্যে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আসকের তথ্যানুযায়ী, গত বছর নভেম্বরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত সাতজন নারী। ওই মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২টি, এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ দুটি। ধর্ষণচেষ্টা সাতটি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। ডিসেম্বরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৩টি, এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছয়টি। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে সাতজনকে।

তবে শুধু এসব তথ্য দিয়ে গত কয়েক মাসে নারীদের হেনস্তা ও আক্রমণ এবং আক্রমণের ধরনের চিত্রটি বোঝা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মব তৈরি করে একাধিক নারীকে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটেছে। পথেঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বক্ষেত্রে নারীরা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

গত ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়টির গ্রন্থাগারের সহকারী বুক বাইন্ডারের বিরুদ্ধে। ওই শিক্ষার্থী জানান, রাজু ভাস্কর্যের সামনে ওই ব্যক্তি তাঁকে ওড়না ঠিক করাসহ নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন। পরে ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে সেদিন রাতেই তাঁর মুক্তির দাবিতে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একদল লোক শাহবাগ থানায় অবস্থান নেয়। পরদিন বিকেলে জামিনে মুক্তি পেলে তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন ছাত্রীকে বহিষ্কারের চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকে সমালোচনা করছেন।

রাজধানীর লালমাটিয়ায় ধূমপানকে কেন্দ্র করে মব তৈরি করে দুই নারীর ওপর আক্রমণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নিরাপত্তার খাতিরে দুই নারীকে থানায়ও নিয়ে যাওয়া হয়। পরে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত রবিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি তারা (দুই তরুণী) নাকি সিগারেট খাচ্ছিল, কিছু লোক সেখান দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। তারা (লোকেরা) বাধা দেওয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়ে মেরেছিল। পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ।’

অন্যদিকে এ ঘটনায় আপস হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে উভয় পক্ষ পুলিশের সামনে একটি আপসনামায় স্বাক্ষর করেছে। ফলে এটিকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করতে হচ্ছে। মব জাস্টিস বা মোরাল পুলিশিংয়ের কোনো সুযোগ এ দেশে নেই। সরকার এর বিরুদ্ধে সব সময়ই শক্ত অবস্থানে আছে।’

এর আগে গত আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দেশে নারীর ওপর একাধিক আক্রমণ ও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরই ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে মেয়েদের ফুটবল খেলায় বাধা দেওয়া হয়।

বিনোদন জগতের একাধিক তারকাও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কথা ছিল চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। অপু বিশ্বাস রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করবেন—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানকার স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ জানান। পরে অপু বিশ্বাসকে দিয়ে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। ওই মাসেই একই রকম বাধার মুখে পড়েন নায়িকা পরীমনিও। এর আগে গত বছর নভেম্বরে ‘সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তাওহীদি জনতার’ ব্যানারে কিছু ব্যক্তির বাধার মুখে চট্টগ্রাম নগরে শেরুম উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী।

এদিকে কাছে কয়েকজন নারী সামপ্রতিক সময়ে তাঁদের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন। নাসরিন সুলতানা (ছদ্মনাম) দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কল সেন্টারে কাজ করেন। রাজধানীর মগবাজার থেকে তেজগাঁওয়ে অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আগস্ট বা সেপ্টেম্বর থেকে আমি লক্ষ্য করলাম, বাসে আগের মতো মেয়েদের জন্য সিট সংরক্ষিত থাকছে না। আগে একটা মহিলা সিটে একজন পুরুষ বসা থাকলেও কোনো মহিলা উঠলে বাসে তিনি আসন ছেড়ে দিতেন। কিংবা চালক বা তার সহকারী ওই ব্যক্তিকে বাধ্য করতেন সিট ছেড়ে দিতে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে এই চিত্র আর দেখছি।’

এদিকে গত বুধবার ঢাকার মতিঝিল থেকে উত্তরাগামী মেট্রো রেলে নারীদের কোচে উঠে পড়া পুরুষ যাত্রীদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে থাকা এক নারী চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘নারীদের জন্য সংরক্ষিত বগিতে ১০-১২ জন পুরুষ ছিল। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে তারা এক শিশুসহ নারীদের শ্লীলতাহানি করে।

এ ছাড়া গত সাত মাসে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে তরুণীদের হেনস্তা, রাজধানীতে ভাসমান যৌনকর্মীদের আক্রমণ ও বেধড়ক পিটুনি, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ষাটোর্ধ্ব এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, মেট্রো রেল ও গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের যৌন নিপীড়নের মতো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, হয়রানি, বিদ্বেষসহ নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে গত বুধবার বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলছে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নারীবিদ্বেষী কথা বলেছেন এবং সেটির সঙ্গে আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যাকে কৌশলে যুক্ত করে দিয়েছেন।…“দেশে ‘মব ইনজাস্টিস’ তৈরি করে বিষোদ‌গারের চর্চা তো বন্ধ হচ্ছেই না, উল্টো তা দিন দিন বাড়ছে এবং এবার এর শিকার বানানো হয়েছে (লালমাটিয়ায়) দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে।”

নারীকে হেনস্তা ও নারীবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড বেড়ে চলছে বলে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘নারী নির্যাতনের তথ্য দিয়ে সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলোকে পুরোপুরি মেলানো যাবে না। আমাদের এখানে মামলার ভিত্তিতে আমরা সামগ্রিক নারী নির্যাতনের তথ্য দিই। এর মধ্যে দেখা যায় পারিবারিক সহিংসতাই বেশি। শুধু নারী নন, সব নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘নারীর ওপর মোরাল পুলিশিং বা নৈতিক অনুশাসন এখন তৌহিদী জনতার হাতে চলে গেছে। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘দেশে মব ভায়োলেন্স অব্যাহত আছে। নারীদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি আগেও ছিল; এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। তারা যদি না করে আমাদের জনগণের অসহায় হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

দেশে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য জানতে অন্তর্বর্তী সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।