বাণিজ্য শুল্ক আলোচনার আমন্ত্রণ পায়নি বাংলাদেশ

#কাল অনলাইন মিটিং

দু’দিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রনালয় থেকে সিডিউল চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টটেটিকে (ইউএসটিআর)। তবে শুল্ক আরোপের বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা করতে এখনো আমন্ত্রণ পায়নি বাংলাদেশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তিবিষয়ক তৃতীয় দফার আলোচনা কবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে চলতি জুলাই মাসের মধ্যে তা না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।


এদিকে, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এখনো আশা করছেন, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে এবং ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ শুল্ক নির্ধারণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা শুল্কের হার কমানো বাস্তবতার নিরিখে ‘কঠিন হবে’ বলে মনে করছেন। এদিকে, আলোচনার জন্য দেশটির কাছে বারবার সময় চেয়েও না পাওয়ার কারণে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। লবিস্ট নিয়োগের ব্যাপারেও তারা হাল প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ আগস্ট কার্যকর হয়ে যাবে পাল্টা শুল্কের হার। এরপরও অবশ্য আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কাল শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি অনলাইন মিটিং হবে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক কমানোর বিষয়ে দেশটির কাছে লেখা চিঠির জবাব এখনো পায়নি। চিঠির জবাব এবং দেশটিতে আবার সফরের আমন্ত্রণ পেতে শেষ মুহূর্তেও অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তৃতীয় দফার আলোচনার ব্যাপারে আশাবাদী।

আলোচনা করতে ১ আগস্টের আগেই বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে যাবে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ আলোচনা থেকে ভালো একটা ফলও নিয়ে আসা যাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে মনে করা হচ্ছে। নতুন শুল্কহার কার্যকরের সময় আরেক দফা বাড়তেও পারে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, শুল্ক ইস্যুটি এখন সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তিনি বলেন, অনেক বিষয় সরকার ডিসক্লোজ (প্রকাশ) করতে পারছে না। তবে যেটা উঠে এসেছে, সরকার দেশ ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট নানান শর্ত দিচ্ছে, যেগুলো বাংলাদেশের জন্য কঠিন। যদিও তাদের সঙ্গেই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। তার বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। আর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করেছিল ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা সর্বশেষ অগ্রগতির কতদূর জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমরা গত পরশুদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রীকে আমাদের করণীয় সম্পর্কে একটি পত্র দিয়েছি। আমরা জবাবের অপেক্ষায় আছি। আমরা আমন্ত্রণের অপেক্ষায়ও আছি। জবাব এবং আমন্ত্রণ পেলে আমাদের নেগোসিয়েশন টিমসহ সবাই একত্রে মিলে আমরা যাব।
আগামী ১ আগস্ট থেকে শুল্ক কার্যকর হবে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমাদের জন্য যেমন প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমাদের কর্মকাণ্ডে কোনো স্থবিরতা নেই। কর্মকাণ্ড যথেষ্ট গতিশীলতার সঙ্গে এগোচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান সঠিকভাবে তুলে ধরেছি। সক্ষমতার ভিত্তিতে আমাদের যা করণীয়, সেই করণীয় তুলে ধরার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখন উনাদের [যুক্তরাষ্ট্রের] আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আছি। আমন্ত্রণ পেলেই চলে যাব। শুল্কহার নিয়ে দর কষাকষির বিষয়ে বাংলাদেশ কী প্রত্যাশা করছে এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমরা প্রত্যাশা করছি ভালো কোনো কিছু। ভালো কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে যা করণীয় সেগুলোই আমরা করছি। সর্বশেষ যে মিটিং করেছেন সেখানে কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিলেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে বশিরউদ্দীন বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে আমাদের জন্য হয়তো ভালো কিছু হবে, ইনশাল্লাহ্।
এদিকে পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করতে লবিস্ট নিয়োগের সম্ভাবনাও এখন প্রায় শূন্যের কোটায় বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সরকারের মনোভাবও নেতিবাচক। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, লম্বা সময় নিয়ে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সাধারণত লবিস্ট নিয়োগ করা হয়। এখানে যা করতে হবে, জলদি করতে হবে। লবিস্টদের দিকে ইঙ্গিত করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দর-কষাকষি দূরের কথা, তারা তো ঢুকতেই পারবেন না ওই অফিসের কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভালো আছে বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির বকেয়া পরিশোধ করে দেয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি ও মেটলাইফের বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ইউএস চেম্বার আমাকে চিঠি লিখেছে।

লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে গতকাল অর্থ উপদেষ্টার সুরেই কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। বাংলাদেশি পণ্যে বাড়তি শুল্ক কমানোর দর কষাকষির জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, এটি ব্যবসায়ীদের এখতিয়ার। সরকার কোনো লবিস্ট নিয়োগ করেনি। আপনাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল ইমারজেন্সি বিনিময়ে কাজটি করছে। এখানে যে কাঠামোর ওপর ঘটনাটা ঘটছে, এ কাঠামোতে লবিস্টদের করার কোনো কিছু আছে কি না আমি ঠিক জানি না।

তিনি বলেন, আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। এ পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। পরিবর্তনগুলোতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো আইনি প্রক্রিয়া আছে। এ আইনি প্রক্রিয়াগুলো একজন লবিস্টের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। আমরা সরকারের প্রায় সব মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছি। গত ১৫ দিন ধরে দিন-রাত কাজ হয়েছে এটির ওপর। আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি, আশা করি ওনাদের আমন্ত্রণ পেলে চলে যাব।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার কার্যকরের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে দর কষাকষি বা আলোচনার আমন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, আমরা হয়তো একটা অনলাইন মিটিংয়ের সিডিউল পাচ্ছি আজ-কালকের মধ্যে। বিষয়গুলো গতিশীলভাবে এগোচ্ছে বলেই চিঠির ওপর ভিত্তি করে তারা একটি অনলাইন মিটিংয়ের সিডিউল দিয়েছে। অনলাইন মিটিংয়ের ভিত্তিতে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড করব। অনলাইন মিটিং সম্ভবত কাল (শুক্রবার) হবে। শুল্ক ইস্যুতে ১ আগস্টের পরবর্তী সময়েও কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হবে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, অবশ্যই হবে, ইনশাল্লাহ্ হবে।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নতুন করে বৈঠকে বসেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিটিং বিষয়ে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, লবিস্ট নিয়োগ হবে না বলে ধরে নিচ্ছি। চেষ্টা চলছে। তবে এখন তা করেও কী লাভ হবে, বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশ্বাস দিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত ভালো কিছুই হবে।

বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর চেষ্টা সরকারের : যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি গম আমদানির একটি প্রস্তাব বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। একই দিন দেশটি থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয় সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে। এ দফায় বাংলাদেশে গম রপ্তানির কাজ পেয়েছে অ্যাগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। কোম্পানিটি ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটসের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বলে ক্রয় কমিটিকে জানায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি টন গমের দাম পড়ছে ৩০২ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ গমের প্রতি টনের দাম ৮১৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা একটু বৈচিত্র্য আনতে চাচ্ছি। অনেক সময় রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে অনিশ্চয়তা দেখা যায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন আমাদের আমদানি বৃদ্ধির দর-কষাকষি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের গমের মানও ভালো।

এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ