বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার, কনসালটেন্ট, সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ প্রক্রিয়াধীন সকল নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তৃতীয় দফায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এবং সুপারিশের ভিত্তিতে পুরো নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিএসএমএমইউয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেটে তদন্ত কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম।
অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, অনেকেই দেখলাম বিষয়টা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বিষয়টি হলো ২০২৩ সালের জনবল নিয়োগের জন্য যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে তার পরীক্ষা ভাইভাসহ সকল ধরনের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তবে চূড়ান্ত ফলাফল এখনও দেওয়া হয়নি।
এ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে যেহেতু নানা ধরনের বিতর্ক পত্র-পত্রিকায় এসেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও তার প্রমাণ পেয়েছে এবং সুপারিশ করেছে, তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে।
এ সময় বিএসএমএমইউ উপাচার্য আরও বলেন, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে হলে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার জনবল প্রয়োজন। আমরা সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছি।
জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের জন্য ২০২৩ সালের ৩ জুলাই শূন্য পদে জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে ৫২ পদে ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। পদগুলোর মধ্যে কনসালট্যান্ট পদে ৯৬ জন, মেডিকেল অফিসার (মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিকস) পদে ৬০ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে ২২৫ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ ছাড়াও এই বিজ্ঞপ্তিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ), পরিচালক (আইটি), টেকনিশিয়ান, টেকনোলজিস্টসহ সব মিলিয়ে ৫৪৪ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়।
এরপর আবার ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আট ক্যাটাগরির পদে চতুর্থ থেকে নবম গ্রেডে ১৭২ জন জনবল নিয়োগে পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ৬৮টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা চাওয়া হয় বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত এমবিবিএস বা সমমান ডিগ্রি এবং বিএমডিসি কর্তৃক স্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্তদের।
এই বিজ্ঞপ্তিতে বিভাগীয় প্রার্থী ও বিএসএমএমইউ থেকে প্রাপ্ত পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সের সময়সীমা রাখা হয় অনূর্ধ্ব ৩২ বছর পর্যন্ত। তবে বিভাগীয় ও অভিজ্ঞ প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য বলেও উল্লেখ করা হয়, যার বেতন স্কেল হবে ২২,০০০-৫৩,০৬০ টাকা (গ্রেড-৯)।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ৬৮ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিতে সে বছরেই (২০ অক্টোবর) লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২১ অক্টোবর রাত ৮টার পর। তবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন সবকিছুতেই বড় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এমনকি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। যা তখন গণমাধ্যম ও তদন্ত কমিটি প্রমাণ পান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এতো বড় অনিয়ম আর যা আর কখনও হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন হলে সকল সিন্ডিকেট সদস্যও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
তদন্ত কমিটিতে থাকা একাধিক ব্যক্তি বলেন, আমরা অনিয়মের সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করেছি। যেখানে কল রেকর্ড ছিল, সিসিটিভি ফুটেজ ছিল, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনের স্ক্রিনশট ছিল, পেনড্রাইভে প্রশ্ন নেওয়া অভিযুক্ত চিকিৎসকের মিষ্টি বিতরণের ছবিসহ আরও অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করেছি। সবমিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রত্যেকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের সুপারিশ করেছি।
তারা বলেন, যদি এই সংস্কারগুলো করতে পারি, সকল অনিয়ম-দুর্নীতির মূল হোতাদের যদি আইনের আওতায় আনতে পারি, তাহলে আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসবে।