ইশরাত ইয়াছিন ইকরা : গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তাদের সংখ্যা বর্তমানে ৩৫ লাখ ছাড়িয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মগত ত্রুটি, পরিবেশ দূষণ এবং দুর্ঘটনা এই বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। অর্থাৎ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যাক্তিরা সমাজের অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন। কেউ কানে শোনে না, কেউ চোখে দেখে না, কারও বুদ্ধি কম, কেউ আবার শারীরিকভাবে অক্ষম। পরিবার তথা সমাজের কাছে তাদের বোঝা মনে হয়। কিন্তু তারা বোঝা নয়, বরং সম্পদ। অক্ষম এ মানুষদের প্রয়োজন সঠিক যত্ন ও অধিক স্নেহ-ভালোবাসা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা প্রায় ৪৬ দশমিক ২ লাখ। এর মধ্যে ২৬ দশমিক ৮ লক্ষ পুরুষ এবং ১৯ দশমিক ৩ লাখ নারী।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ৯১-৯ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী। দেশে মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধিতা শারীরিক, এ হার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরপর আছে যথাক্রমে দৃষ্টি, শ্রবণ ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা। মাঠপর্যায়ের একটি জরিপ বলছে, বেশির ভাগ প্রতিবন্ধিতার কারণ জন্মগত ও অসুস্থতা। এছাড়াও গাছ বা ছাদ থেকে পড়ে অথবা দুর্ঘটনায় কেউ শারীরিকভাবে অক্ষম হলে তারাও প্রতিবন্ধী।
তবে বয়সভিত্তিক প্রতিবন্ধিতার হিসাবে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার তুলনামূলক বেশি। জরিপে আরও দেখা যায়, তিন বছর বা এর বেশি বয়সের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৫৫ শতাংশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় তারা বিলম্বে পড়াশোনা শুরু করে। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রতিবন্ধী শিশুদের ৩৫ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি ৪৯ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করেছেন। তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সি প্রতিবন্ধীদের প্রতি তিনজনে একজন কর্মে নিয়োজিত। নিবন্ধন রয়েছে এমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ভাতা পাচ্ছেন ৯১ শতাংশ।
মায়ের কষ্ট: জন্মগত প্রতিবন্ধীতার গল্প
গাজীপুরের সাথী বেগমের আট বছর বয়সী সন্তান রাকিব জন্ম থেকেই চলাফেরা করতে অক্ষম। সাথী বলেন, গর্ভকালীন সময় থেকে প্রয়োজনীয় কোনো চিকিৎসা পাইনি। চিকিৎসার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। এখন অর্থের অভাবে ছেলের চিকিৎসা ও চালানো কঠিন।”
রাকিবের মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়েদের পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে শিশুদের জন্মগত ত্রুটি বাড়ছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় গর্ভকালীন সময়ে মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
পরিবেশ দূষণের তীব্র প্রভাব
পরিবেশ দূষণ প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে। দূষিত পানি, বাতাস এবং খাদ্যে রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার মানুষের জিনগত গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারায়ণগঞ্জের মেহের আলীর কন্যা চোখে দেখতে পায় না। মেহের বলেন, আমাদের এলাকায় পানি দূষণ এত বেশি যে, মানুষ শুধু রোগ ও অসুস্থতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষিত পরিবেশ মানুষের শরীরের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শুধু এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রতিবন্ধীতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
সড়ক দুর্ঘটনা ও অঙ্গহানির ক্ষতি
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবনকে অচল করে দেয়। ২৫ বছর বয়সী ফারুক সাম্প্রতিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পা হারিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলাম। এখন আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
যথাযথ সড়ক নিয়ম মেনে চলা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।
খাদ্যে ভেজাল একটি নীরব ঘাতক
খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোও প্রতিবন্ধীতার হার বাড়ানোর একটি কারণ। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না করতে পারলে এটি মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এবং শারীরিক গঠনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। শিশুদের বয়সানুপাতিক বৃদ্ধি ও স্বাভাবিক শারীরিক ক্ষমতা এতে বাধাগ্রস্ত হয়।
সমস্যা সমাধানে করণীয়
সমস্যার মূল কারণ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। গর্ভকালীন উন্নত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চিত করা, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া, খাদ্যের ভেজাল বন্ধ করা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদেরকে সমাজে প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধ, পারিবারিক কলহ ও স্ত্রী নির্যাতন রোধ এবং আন্তঃপারিবারিক বিবাহ না করতে সমাজের মানুষকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এ ছাড়া, সমাজে তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকের করণীয়
লক্ষণগুলোকে গোপন করবেন না। হতাশ হবেন না, অযথা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকুন এবং সমস্যাটির ব্যাখ্যা নিন। পরিবারের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিন, নিজেদের দায়ী করবেন না। এটি কোন অভিশাপ নয়।
অটিজম বোঝা নয়, সম্ভাবনার নতুন সম্ভার
অটিজমে শিশুরা কখনো কখনো বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। এই ধরনের শিশুদের তাই বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়।
যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে বিধায় এদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়।
তারা আর্ট, মিউজিক, নাচ, গণিত, ফিজিক্স বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়। নিউটন, আইনস্টাইন, ডারউইনের মত বিজ্ঞানীদের অটিজম ছিল বলে ধারণা করা হয়।
শেষ কথা
সাথীর সন্তান রাকিব হোক, কিংবা ফারুক বা মেহেরের মেয়েÑ তারা সমাজের বোঝা নয়। সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের সমাজে প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান করা সম্ভব। একসঙ্গে কাজ করলে আমরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধকতা গুলো কমিয়ে একটি সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে পারি।