ব্যবসা গুটিয়ে নিতে এক্সিটপলিসি চান ব্যবসায়ীরা

চড়া সুদহার, জ্বালানি সংকট, সেই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎয়ের দাম আবারো বাড়ানোর পাঁয়তারার খবরে কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাজ ব্যবসায়ীদের। তাদের দাবি দেশে এখন ব্যবসার পরিবেশ নেই, আর তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে এক্সিট পলিসি চাইলেন তারা। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এপ্রিলে খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম চালু হলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তার উপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ, শ্রমিকের বেতন ভাতা বাড়ানোকে ব্যবসার অন্তরায় হিসেবে দেখছেন তারা। একইসঙ্গে ব্যাংকের একক গ্রাহকের ঋণসীমা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) নেতৃত্বে রবিবার বেশ কয়েকটি সংগঠনের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে এমন দাবি করেন। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এ সময় বিজিএমইএ’র প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন, বিসিআই’র পরিচালক ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী, এলএফএমইবি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল হাসান সোইল, রাভিডার সভাপতি আব্দুল হক, বিসিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মইনুল ইসলাম স্বপন, সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসান, কোকাকোলা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদাপ আহমেদ, বিসিআই’র সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রীতি চক্রবর্তী, সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ সাংবাদিকদের বলেন, একসঙ্গে ঋণের সুদহার বাড়ানো, গ্যাসের দাম বাড়ানো, বেতন বাড়ানো, প্রণোদনা দেয়া- এভাবে ব্যবসা চালানো কঠিন। কোনো দেশে এমনটা নেই। এজন্য আমরা চাই বড় শিল্পের জন্য এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১২ বছরের ঋণ সুবিধা এবং ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হোক। ছোট শিল্পের জন্য এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের ঋণ সুবিধা চাই, যেখানে এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনঃতফসিলের সুবিধা থাকবে। এজন্য পৃথক সার্কুলার দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের মর্টগেজ সম্পদ বিক্রির জন্য অনুমোদন নিতে হবে। ব্যাংকের একক গ্রাহকের ঋণসীমা আগের অবস্থানে নেয়ার দাবি জানাই। একটি ব্যাংক বর্তমানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে একজন গ্রাহককে মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এর আগে এ সীমা ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও তা পরিবর্তন করা হয়েছিল। এতে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন, বিশেষ করে এলসির (ঋণপত্র) ক্ষেত্রে।
তিনি আরো জানান, নগদ প্রণোদনার জন্য যে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র জমা দিতে ন্যূনতম ৯ থেকে ১২ মাস সময় লাগে, এরপর বিতরণ করতে ৮ থেকে ১২ মাস সময় লাগে। এ সময় নামিয়ে আনতে হবে ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে। ব্যাংক সুদের হার ৯ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো, যে সংকট সমাধান করা অসম্ভব। এ সমস্যা নিরসনের জন্য জোর দাবি জানাই। কোনো উৎপাদনমুখী শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য সুদহার কমানোর দাবি জানিয়েছি। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য একটি প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিএমএসই খাত সব থেকে ক্ষতির মূখে পড়েছে আমাদের সিএমএসই খাতকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মনে করি সিএমএসই খাতের বিশেষ তহবিল এবং নিম্ন সুদে সুদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এ খাতে একটি জেলা বা একটি ক্লাস্টারকে পাইলট ধরে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অর্থায়ন করা যেতে পারে।
পারভেজ চৌধুরী বলেন, আমাদের একটা এক্সিট পলিসি দরকার। হেরে যাওয়া থেকে অন্তত মানসম্মান নিয়ে ব্যবসা করে যেতে চাই। এ নিয়ে আমাদের জোর দাবি ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকও এটা নিয়ে কাজ করছে। ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার যে শর্ত ঠিক করা হয়েছে, তা শিথিল করার দাবি জানাই। গ্রাহক ছয় মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি হবে, এটাকে অন্তত ৯ মাসে নিয়ে যাওয়ার দাবি করেছি। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে শিল্প সার্ভাইভ করতে পারবে না। শিল্পে এলসি খোলায় এখনো জটিলতা রয়েছে। যে রিফর্ম কমিটি গঠন করা হয়েছে, আমরা সেখানে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি রাখার কথা বলেছি। সবকিছুতে খরচ বাড়লে শিল্পের গ্রোথ কীভাবে হবে? ললিপপ দিয়ে শিল্প চলে না, এজন্য সাপোর্ট লাগে। অর্থনীতির স্বার্থে বিভিন্ন দেশের শিল্প এগিয়ে নিতে এ ব্যবস্থা রাখা হয়।
বিজিএমইএ প্রশাসক আনোয়ার হোসাইন বলেন, এলসি জটিলতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি কমাতে হবে সুদের হারও। ব্যাংক রিফর্ম কমিটিতে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্তি এবং অ্যাগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিকে গুরুত্ব দিয়ে সাপ্লাই চেইন ঠিক করার দাবিও করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বিনিয়োগবান্ধব হতে পারেনি বাংলাদেশ। এখনও এদেশে বিনিয়োগ করতে হলে, ২৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৪১টি ছাড়পত্র নিতে হয় একজন উদ্যোক্তাকে। অন্যদিকে গত ৩ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৫০ শতাংশ থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ শতাংশ। যদিও আবার দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সঙ্গে উচ্চ সুদের হার, এলসি জটিলতা, বেতন-বোনাস, উৎপাদন খরচ ও ডলার রেট বৃদ্ধিতে এখন নাজেহাল অবস্থা তাদের। ব্যবসায়ীদের দাবি বর্তমান পরিস্থিতিতে, দেউলিয়া আইনের পরিবর্তন চান তারা। বলেন, খেলাপি হয়ে জেলে যাওয়ার পরিবর্তে এক্সিট পলিসি অর্থাৎ ব্যবসা থেকে সম্মান নিয়ে বেরিয়ে যেতে চান তারা।