যেসব শহরে হামলা চালিয়েছে ভারত, যেভাবে জবাব দিল পাকিস্তান

ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে স্থানীয় সময় বুধবার (৭ মে) গভীর রাতে পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়েছে। এ অভিযানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ৯টি স্থানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। খবর এনডিটিভির।

নয়াদিল্লি দাবি করেছে, তাদের পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর আওতায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের যে ৯টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, সেগুলো বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

ভারতের ভাষ্যমতে, এই লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর কয়েকটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অভিযান মূলত গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত হামলার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয়েছে। সেই হামলায় ২৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়্যবা এই হামলার সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হলেও, গোষ্ঠীটি আনুষ্ঠানিকভাবে এর দায় স্বীকার করেনি।

ভারতের এই প্রতিশোধমূলক হামলাটি লস্কর-ই-তৈয়্যবা, জয়শ-ই-মোহাম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিন এবং অন্যান্য সহযোগী নেটওয়ার্কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক, অপারেশনাল ও প্রশিক্ষণ অবকাঠামো ভেঙে ফেলার সুপরিকল্পিত কৌশল। এই অভিযানের জন্য নির্বাচিত ৯টি স্থানের প্রতিটিরই ভারতে সংঘটিত বড় ধরনের সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্র এবং অনুপ্রবেশ প্রচেষ্টার সঙ্গে ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে।

ভারতের পক্ষ থেকে যে কারণে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার দাবি করা হয়েছে, সেগুলো হলো—

১। বাহাওয়ালপুর (দক্ষিণ পাঞ্জাব) : জয়শ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত। মাসুদ আজহারের নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী ২০০১ সালের ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ভারতে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের হামলার দায় স্বীকার করেছে বা সেগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল।

২। মুরিদকে (লাহোর থেকে ৪০ কিমি উত্তরে) : লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও এর দাতব্য শাখা জামাত-উদ-দাওয়ার দীর্ঘদিনের কেন্দ্রস্থল। ২০০ একরেরও বেশি বিস্তৃত এই ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ এলাকা, মতাদর্শ কেন্দ্র এবং লজিস্টিক সহায়তা অবকাঠামো রয়েছে। ভারত এই সংগঠনটিকে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে, যেখানে ২৬/১১ হামলার সন্ত্রাসীরা এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।

৩। কোটলি (পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর) : আত্মঘাতী বোমা প্রস্তুতকারক ও বিদ্রোহীদের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। ভারতের সূত্র অনুযায়ী, এই কেন্দ্রে যেকোনো সময় ৫০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থীর ধারণক্ষমতা রয়েছে।

৪। গুলপুর (ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কাছে) : ভারতের দাবি, এই এলাকাটি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজৌরি ও পুঞ্চে অভিযানের জন্য বারবার অগ্রবর্তী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা সূত্র মনে করে, এই স্থানটি ওই অঞ্চলে ভারতীয় নিরাপত্তা কনভয় ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল।

৫। সাওয়াই (কাশ্মীর উপত্যকা) : ভারতে মনে করা হয়, এই ঘাঁটিতে কাশ্মীর উপত্যকায় হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

৬। সারজাল (আন্তর্জাতিক সীমান্ত/নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে) : সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের অন্যতম প্রধান পথ হিসেবে চিহ্নিত।

৭। বার্নালা (আন্তর্জাতিক সীমান্ত/নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে) : সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের জন্য ব্যবহৃত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

৮। মেহমুনা (শিয়ালকোটের কাছে, পাঞ্জাব) : ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরে সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিজবুল মুজাহিদিন কর্তৃক ব্যবহৃত প্রশিক্ষণ শিবির। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই গোষ্ঠীর কার্যকলাপ কিছুটা কমলেও ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, সীমান্তের ওপার থেকে, বিশেষ করে মেহমুনের মতো এলাকা থেকে তাদের অবশিষ্ট সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়াও, ভারত আরও কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলার দাবি করেছে :

১. মারকাজ সুবহান আল্লাহ, বাহাওয়ালপুর : জয়শ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটি।

২. মারকাজ তাইয়্যেবা, মুরিদকে : লস্কর-ই-তৈয়্যবার ঘাঁটি।

৩. সারজাল, তেহসিল কালান : জয়শ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটি।

৪. মেহমুনা জয়া, শিয়ালকোট : হিজবুল মুজাহিদীনের ঘাঁটি।

৫. মারকাজ আহলে হাদিস, বার্নালা : লস্কর-ই-তৈয়্যবার ঘাঁটি।

৬. মারকাজ আব্বাস, কোটলি : জয়শ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটি।

৭. মাসকার রাহিল শহীদ, কোটলি : হিজবুল মুজাহিদীনের ঘাঁটি।

৮. সাওয়াই নাল্লা ক্যাম্প, মুজাফফরাবাদ : লস্কর-ই-তৈয়্যবার ঘাঁটি।

৯. সাইয়্যেদুনা বিলাল ক্যাম্প, মুজাফফরাবাদ : জয়শ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটি।

পাকিস্তান জানিয়েছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে আটজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৩৬ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। এই পদক্ষেপকে ইসলামাবাদ ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ হিসেবে অভিহিত করে এর কঠোর এবং উপযুক্ত জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরই ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে লিখেছে, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

এদিকে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী দ্রুত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়। তারা পাঁচটি ভারতীয় বিমান বাহিনীর (আইএএফ) যুদ্ধবিমান, একটি ড্রোন এবং একটি ব্রিগেড সদর দপ্তর ধ্বংস করার দাবি করেছে।

রয়টার্সের কাছে একজন সামরিক মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, ধ্বংস হওয়া ভারতীয় বিমান বাহিনীর জেটগুলোর মধ্যে তিনটি ফ্রান্স-নির্মিত রাফায়েল, একটি এসইউ৩০এমকেআই এবং একটি মিগ-২৯ ফুলক্রাম রয়েছে।

পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর)-এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন, ভারতীয় বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষের পরেও পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সব জেট সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে।

এ ছাড়াও, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) ধুন্দিয়াল সেক্টরে শত্রুদের একটি পোস্ট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে এবং একটি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র গোলাগুলি বিনিময় অব্যাহত রয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের গুলিবর্ষণে তিন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও সাতজন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই হামলার সমুচিত জবাব দেওয়া হয়েছে।

এর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত আক্রমণ’ আখ্যায়িত করে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন।

পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় দেশের কাছে ‘সর্বোচ্চ সামরিক সংযমের’ আহ্বান জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহতের পর থেকেই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। ভারত ওই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ বরাবরই তাদের কোনো প্রকার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের এই সামরিক পদক্ষেপ আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।