সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও টালমাটাল নিত্যপণ্যের বাজার। কমছেই না চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও মাছ-মাংসের দাম। উল্টো নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে কাঁচামরিচ ও সবজির দাম। খাদ্যপণ্যের সংকট না থাকলেও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে খোদ প্রশাসনকেই। বিক্রেতা ও মজুতদারের আচরণে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতারা। তবে টানা খরা ও পরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পণ্যের দাম বেশি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
শনিবার (৫ অক্টোবর) নগরীর সাহেব বাজার, শিরোইল, সাগরপাড়াসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, ছুটির দিন হওয়ায় বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই জমেছে বেচাবিক্রি। অধিক ক্রেতা সমাগমে খুশি দোকানীরাও। তবে মাত্রাতিরিক্ত দ্রব্যমূল্যে দিশাহারা ক্রেতারা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টির অযুহাতে আকাশ ছুঁয়েছে কাঁচামরিচের দাম। একমাসের ব্যবধানে দাম ছাড়িয়েছে দ্বিগুণ। আমদানি মোটামুটি থাকলেও দাম বেড়ে হয়েছে ৪০০ ছুঁই ছুঁই। বাজারে প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কাঁচামরিচ। অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধিতে বেকায়দায় পড়েছেন অল্প আয়ের ক্রেতারা।
এদিকে কাকরোল, মুলা, ঝিঙ্গা, শসা ও ঢেঁড়স বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। যা গত সপ্তাহেও ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। আর কেজিতে ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বেড়ে করলা ১৪০ টাকা ও বেগুন ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে অপরিবর্তিত আছে আলু ও পেঁয়াজ-রসুনের দাম। আগের মতোই প্রতি কেজি আলু ৬০ টাকা, পেঁয়াজ জাতভেদে ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকা, আদা ২৮০ টাকা ও রসুন ২৪০ টাকায় পাওয়া গেছে।
মুরগির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে অপরিবর্তিত আছে প্রায় সব রকমের মুরগি ও ডিমের দাম। গত সপ্তাহের মতোই প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা, দেশি মুরগি ৪৭০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৭০ টাকা ও পাতিহাঁস ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ডিমের মধ্যে প্রতি হালি ফার্মের সাদা ডিম ৪৮ টাকা, লাল ডিম ৫২ টাকা, হাঁসের ডিম ৭০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ৬২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সম্প্রতি ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করে দেয় সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা, সোনালি মুরগি সর্বোচ্চ ২৭০ টাকা ও ডিমের দাম সর্বোচ্চ ডজন প্রতি ১৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, আমদানি বেশি থাকলেও বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে প্রায় সব রকমের মাছই। প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে পাঙ্গাশ ২০০ টাকা, রুই মাছ ৩০০ টাকা, সিলভার কার্প ২২০ টাকা, মৃগেল মাছ ২৫০ টাকা, কাতল মাছ ৩৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও ইলিশ আকারভেদে ১২শ থেকে ১৮শ টাকা, পাবদা ৫০০ টাকা, দেশি কৈ ৬০০ টাকা, পুঁটি ৬০০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ টাকা ও বোয়াল ৫০০ টাকা কেজিতে পাওয়া গেছে। আর গরুর মাংস ৭০০ টাকা ও খাসির মাংস ১ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।
বাজারে আগের মতো বেশিই রয়েছে চাল ও মুদি দোকানের জিনিসের দাম। বাজারে প্রতি লিটার প্যাকেটজাত সয়াবিন ১৮৫ টাকা, পাম অয়েল ১৬৫ টাকা ও সরিষার তেল ১৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর চালের মধ্যে মিনিকেট ৭৫ টাকা, আটাশ ৬৮ টাকা, স্বর্ণা ৬২ টাকা, নাজিরশাইল ৯৫ টাকা, বাসুমতি ৯০ টাকা ও চিনিগুড়া ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চাল ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, সব ধরনের চালের দাম কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৭ টাকা বেড়েছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে সব পণ্যের দাম। উৎপাদন স্বাভাবিক থাকার পরও দাম বৃদ্ধিকে প্রশাসনের অবহেলার ফল হিসেবেই মনে করছেন তারা। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নজরদারিরও দাবি তাদের।
বাজারে আসা মাহবুবুল আলম নামের এক ক্রেতা জানান, বাজারের নিত্যপণ্যের দাম মধ্যবিত্তদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। কাঁচাবাজারসহ দিন দিন সব পণ্যের দাম সীমার বাইরে যাচ্ছে। সরকার দাম কমাতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না জানি না। কিন্তু এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমাদের কষ্টের শেষ থাকবে না। প্রশাসনের উচিত দ্রব্যমূল্যের দিকেও নজর দেওয়া।
শাহাদত হোসেন নামের এক কলেজছাত্র বলেন, গত মাসে ১৫০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ কিনেছি। আজ এসে দেখি তা ৩৭০ টাকা হয়ে গেছে। কাঁচামরিচ ছাড়া রান্না করা যায় না। বৃষ্টির অযুহাতে কাঁচামরিচের দাম সাড়ে ৩শ পার হয়েছে। এত টাকা দিয়ে মরিচ কিনলে ও তেমন ঝাল নেই। ফলে রান্নায় পরিমাণেও বেশি মরিচ দিতে হচ্ছে।
তবে বিক্রেতাদের দাবি, চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। বৃষ্টির কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাজারে কাঁচামরিচের সরবরাহেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মরিচের আমদানিও কম হচ্ছে।
শাহিনুর রহমান নামে এক সবজি বিক্রেতা বলেন, গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির কারণে কাঁচামরিচসহ কয়েকটি সবজির দাম বেড়েছে। বেশি দামে কিনে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। শুধু আমাদের দোষারোপ করে লাভ নেই। এক পাল্লা (৫ কেজি) মরিচ কিনে মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকা লাভ হলে মরিচ বিক্রি পোষায় না। এ রকম দাম থাকলে মরিচ বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে। মূলত গত কয়েক দিনের অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণেই কাঁচামরিচের দাম বেশি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক শারমিন সুলতানা বলেন, সাধারণত বর্ষার মৌসুম, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন মরিচ গাছের ফুল পড়ে যায়, গাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকরা সেভাবে গাছের পরিচর্যা করতে পারেন না, মরিচ সংগ্রহ কমে যায়। সব মিলিয়ে সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণেই বর্ষা মৌসুমে বাজারে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে যায়।
রাজশাহী জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে কোথাও কোনো ব্যবসায়ী পণ্য মজুত করে কোনো সিন্ডিকেট করছে কি না সে বিষয়ে তদারকি করা। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যদি এ রকম অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকে তাহলে আমাদের নিয়মিত অভিযানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের না। মুক্ত বাজারে কোনো পণ্যের দামে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।