বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ পূর্বাভাসে এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের প্রবৃদ্ধির হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। সংস্থাটি মনে করছে, দেশগুলো যদি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারে, তবেই তাদের ভঙ্গুর আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলো সামাল দেওয়া সম্ভব।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস এ তথ্য জানায়। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন ‘দক্ষিণ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’-এ ২০২৫ সালে এই অঞ্চলের সম্মিলিত প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গত অক্টোবরের পূর্বাভাসের তুলনায় এই হার ০.৪ শতাংশ কম। এরপর ২০২৬ সালে প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়ে ৬.১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। তবে, বিশ্ব অর্থনীতির গভীর অনিশ্চয়তা এবং দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্বলতার কারণে এই পূর্বাভাস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি বিদ্যমান বলে জানায় সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কর্মকর্তা মার্টিন রেইজার এই প্রসঙ্গে বলেন, গত এক দশকে একের পর এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক সুরক্ষাকে দুর্বল করে দিয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে হলে দেশগুলোকে তাদের ভঙ্গুর আর্থিক কাঠামো, কৃষিখাতের পশ্চাৎপদতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মতো দুর্বলতাগুলো মোকাবিলা করার জন্য সুনির্দিষ্ট সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করের হার উন্নয়নশীল বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি হলেও, সরকারের রাজস্ব আয় সেই তুলনায় বেশ কম। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের দেশগুলোর গড় রাজস্ব আয় ছিল জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এই হার ২৪ শতাংশ। বিশেষ করে ভোগ কর থেকে রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তবে কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত আয়করের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যায়।
বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের ধারণা, বিদ্যমান করের হার অনুযায়ীও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জিডিপির ১ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব কম আদায় হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ব্যাপকতা এবং বৃহৎ কৃষি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ার পরেও রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ফাঁকি রয়ে গেছে, যা কার্যকর করনীতি ও প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তাকেই তুলে ধরে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রাঞ্জিস্কা ওহনসোর্জ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, কম রাজস্ব আদায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক দুর্বলতার মূল কারণ এবং বর্তমানের মতো অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার করের হার আপাতদৃষ্টিতে বেশি মনে হলেও, আদায় ব্যবস্থা দুর্বল। এর ফলে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ে এবং সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়।
প্রতিবেদনে কর রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কর ফাঁকি রোধ করা, কর আইনকে সরলীকরণ করা, কর আদায়ে কঠোরতা আনা এবং কর পরিপালনের প্রক্রিয়া সহজ করা। এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়ের পরিমাণ কমানো, কর ব্যবস্থাকে সহজ ও একীভূত করে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে লেনদেন করার প্রবণতা কমানো এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করদাতা শনাক্তকরণ ও কর আদায় প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য দূষণ মূল্য নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।