সূর্য ডুবে সন্ধ্যা মাড়িয়ে নামে অন্ধকার। রাত গভীর হয়। পুরো দেশ ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু রাজধানীর কারওয়ান বাজার তখনও জেগে থাকে। রাত যত গভীর হয় কারওয়ান বাজারে মানুষের ভিড় তত বাড়তে থাকে। সারা দেশ থেকে ট্রাক ভরা কাঁচামালসহ হাজার হাজার ব্যবসায়ী এখানে ভিড় জমান। আর এসব কাঁচামালের ক্রেতা মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীরা।
হাজার হাজার ব্যবসায়ীর মাঝে হঠাৎ চোখ পড়ে কয়েকজন নারীর দিকে। যারা ট্রাক থেকে মালামাল নামাচ্ছেন। এই আয়েই তাদের সংসার চলে।
গতকাল শুক্রবার (৭ মার্চ) দিনগত রাত ২টায় সরেজমিনে দেখা যায়, একটি ট্রাক থেকে নামানো কলার কাঁদি সরিয়ে অন্যপাশে রাখছেন এক নারী। কথা বলে জানা যায় তার নাম খোদেজা। কারওয়ান বাজারের পাশের একটি বস্তিতে থাকেন তিনি। একযুগ ধরে কলার কাঁদি সরানোর কাজ করছেন তিনি। রাত ১২টার পর কাজ শুরু করেন, ভোরে শেষ করেন।
কাঁদি সরানোর সময় দু-একটি কলা ঝরে পড়লে তা অন্যত্র সরিয়ে রাখেন খোদেজা। পরে সেটি বিক্রি করে আয় করেন।
খোদেজা এ প্রতিবেদককে জানান, এক যুগ হয়ে গেল কলা কুড়িয়ে সংসার চালান তিনি। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার কুড়ানো কলা বিক্রি করেন। কখনো বেশিও হয়। কাজের বিনিময়ে কলা পান। মানে কাঁদি সরিয়ে দিলে তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়া কলা পান তিনি।
খোদেজা বেগম বলেন, ‘কান্দি সরানোর জন্য আলাদা বেতন পাই না। তারপরও এই কলা বিক্রি করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করি। আর টুকটাক অন্য সবজি বা কাঁচালাম কিনে রাখি। সকালে বিক্রি করে দিই। এখান থেকে যা আয় করি, তিন ছেলে আর এক প্রতিবন্ধী মেয়ের সংসার চালাই। ছেলেগুলো ভালো না। কাজ করতে চায় না। উপার্জন করে না। এখনও আমার গতরেই চলে সব। আর মেয়েটা বিয়ে দিছি আরেক প্রতিবন্ধীর সঙ্গে। তাকেও টানতে হয় আমার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর ধরে একাই সংসার টানছি।’
কলার কাঁদি টানতে টানতে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো ফুরসত পাচ্ছিলেন না খোদেজা। তার পাশেই দৃষ্টি যায় আরেকটি কলা বোঝাই ট্রাকের দিকে। সেখানে দেখা যায় কাজ করছেন রেনু নামের আরেক নারী (৩৮)। তিনি বলেন, এই কলার কাঁদি সরিয়ে খাই আজ ২০ বছর। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকাও আয় করি প্রতিদিন।
টুকটাক ট্রাক থেকে অন্যান্য কাঁচামালও সরিয়ে দেন রেনু। তা থেকেও বাড়তি কিছু আয় হয় তাঁর। খোদেজা ও রেনুর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ব্যাপারে। কিন্তু তারা দুজনই এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। খোদেজা বলছিলেন, মরার আগ পর্যন্ত সংসারটা চললেই হবে। নারী দিবস নিয়ে কী করব?
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা মেলে ফাতেমা নামের এক নারীর। তিনি ক্রেতার কেনা সবজি বস্তায় ঢুকিয়ে দেন। বিনিময়ে তিনি কিছু সবজি পান এবং তা সকালে কারওয়ান বাজারেই বিক্রি করে দেন। ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। এই অর্থ দিয়ে তিনি তাঁর দুই সন্তানের খাবার জোগাড় করেন। তার স্বামী আরেক বিয়ে করে এখন আর খোঁজখবর রাখেন না।
পুরো কারওয়ানবাজারে হাজার হাজার পুরুষ। এর ভেতর সব মিলিয়ে ১০ জনের মতো নারীর দেখা পাওয়া গেল, যারা জীবনযুদ্ধের অগ্রসৈনিক। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন তারা। কারওয়ান বাজার থেকে বেরিয়ে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে এক ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধাকে পান-সিগারেট বিক্রি করতে দেখা যায়। তিনি এই একই জায়গায় ১৭ বছর ধরে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। নাম মনু। তিনি জানান, কারওয়ান বাজারের সবাই তাকে মনু দর্জি নামেই চেনে।
মনু দর্জি বলেন, তার জন্ম মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে। ১২ বছর বয়স থেকে তিনি দর্জির কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর বিয়ে করেন। ২৭ বছর বয়সে তাঁর স্বামী মারা যান। সে সময় তার এক মেয়ে সন্তান ছিল। সেই মেয়েকে নিয়ে সারা জীবন পার করে দিয়েছেন। আর বিয়ে করেননি। ৩৭ বছর ধরে থাকেন রাজধানীর কাঁঠালবাগানের একটি বাসায়। বাসায় একটি সেলাই মেশিন আছে তাঁর। মাঝেমধ্যে লোকের কাপড়চোপড় তৈরি করে দেন। নিজের কাজগুলোও করেন। আর ১৭ বছর ধরে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত পান আর সিগারেট বিক্রি করেন সোনারগাঁও মোড়ে।
মনু দর্জি বলেন, ‘পান আর সিগারেট বিক্রি করে ঘর ভাড়া, খাওয়া খরচ চলে যায়। আর দর্জির কাজ থেকে কিছু আয় হয়, তা রেখে দিই। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি বরিশালে। জামাইকে মাঝেমধ্যে টাকা পয়সা দিই। আমার জীবন অনেক কঠিন। কেউ নেই আমার। এখন বয়স হয়েছে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেও কেউ দেখার নেই। আল্লাহ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে কদিন বাঁচি, এভাবেই কেটে যাবে। তারপর মরে গেলে আজিমপুরে কবরস্থানে রেখে আসবে। তারপর তো সব শেষ হয়ে গেল।’
কাঁঠালবাগানের দিকে যেতে যেতে আরেক নারীর সঙ্গে দেখা হয়, তিনি রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। রাত তখন আড়াইটা। ওই নারী সিটি করপোরেশনের পোশাক পরে ছিলেন। তিনি তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। মূলত তার মা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার। মা অসুস্থ থাকায় তার পরিবর্তে তিনি কাজে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ, তাই আমি ঝাড়ু দিয়ে দিচ্ছি। অনেকদিন ধরে আমিই ঝাড়ু দিয়ে দিই। আগে রাত তিনটার দিকে কাজে আসতাম। রোজার পর থেকে তিনটার আগে কাজ শেষই করে ফেলি।’
যে পাঁচজন নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ এ দিবস সম্পর্কে অবগত নন। তাঁদের অধিকাংশের মতামত প্রায় এমন—নারী দিবস জেনে আর লাভ কী? সেই প্রতিদিনের মতো কাজ করেই খেতে হবে। গভীর রাতেও পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের কাজ করে যেতে হয়।