বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব পহেলা বৈশাখ ঘিরে। প্রতি বছর এই সময়ে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র থাকে উৎসব আয়োজনের ব্যস্ততা। মাটির হাঁড়ি থেকে শুরু করে পোশাক, মুড়িমুড়কি, নাড়ু, মিষ্টি, ইলিশের বাজারসহ সবখানেই সাজ সাজ রব পড়ে যায়। পহেলা বৈশাখসহ বাংলাদেশে উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতি দিন দিন বড় হচ্ছে। নানা ধরনের উৎসবে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্র জানায়, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা, বিভিন্ন ধরনের মুড়িমুড়কি, নাড়ু বাজারেই বিক্রি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এর বাইরে আরো প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার অন্য পোশাক বিক্রি হয় বৈশাখী বাজারে। এছাড়া ইলিশের বিকিকিনি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। একইভাবে মিষ্টির দোকানগুলোয় বৈশাখে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মিষ্টি। সবমিলে বৈশাখে কেবল পোশাক বিক্রি হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। বৈশাখী উৎসব ঘিরে আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম, ক্রেডিট কার্ড ও ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থায় অর্থের পর্যাপ্ত জোগান রাখে। মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও লেনদেন বাড়ে। গত দুই বছর ধরে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সারাদেশে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে। এ বছর সেটি আরো বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ অনেকটাই স্থবির অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া দিন দিন মানুষ ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলছে।
বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের একটি সোনালি পটভূমি রয়েছে, যা ইতিহাস স্বীকৃত; কিন্তু সময় সময় কিছু কিছু ঘটনা আমাদের সার্বিক আয়োজনকে মøান করে দেয়, যা এ বছরও ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-জীবিকা/আয়-রোজগারের প্রশ্ন যেমন কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য, বৈশাখী পোশাকের বাণিজ্য, গ্রামীণ/শহুরে মেলার বাণিজ্য, মৃৎশিল্পী কামার-কুমারদের বাণিজ্য, নাট্য কর্মী, যাত্রা শিল্পী, পালাকারদের আয়-রোজগারের পথসহ আরো কত কিছু রয়েছে এই তালিকায়। নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শহরের অর্থনীতিতে কিছু মানুষ ধনী হন। আর গ্রামের অর্থনীতিতে উপকৃত হন সবাই। গ্রামে বণ্টনের একটা নায্যতা আছে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে আগে গ্রামে মেলা হতো। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখন সেগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ওই মেলাগুলোতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। এক সময় পহেলা বৈখাখে এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। এখন অনেকটাই কমে গেছে।
বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এই উৎসবে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ফুটপাত থেকে বিপণিবিতান সবখানেই পণ্য বেচাকেনার ধুম পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বেচাকেনা বেড়েছে অনলাইনেও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশাখী উৎসব দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সর্বজনীন এই উৎসবে বাড়ছে মানুষের অংশগ্রহণ। সেইসঙ্গে বাড়ছে বৈশাখ কেন্দ্রিক কেনাকাটাও। এতে উৎসবের পাশাপাশি পয়লা বৈশাখ পাচ্ছে বাণিজ্যিক গুরুত্ব। বৈশাখী উৎসব ঘিরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, এই উৎসব সর্বজনীন।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নেয়া হয় নানা প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতিতে পান্তা-ইলিশের পাশাপাশি থাকে নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ছোঁয়ায় তৈরি নতুন পোশাকে সাজগোজ। নতুন বছরকে বরণ করতে বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে চাই নতুন পোশাক। শাড়ি, সালোয়ার কিংবা পাঞ্জাবি, সবকিছুতে থাকবে বাঙালিত্বের ছোঁয়া। এই দিনে নতুন পোশাক পরার প্রচলন বহু বছরের। তাই পহেলা বৈশাখ ঘিরে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোও বাহারি পণ্যের পসরায় সেজেছে। ফ্যাশন সচেতনরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখ রমজান মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ায় উৎসবের জৌলুস কিছুটা কম ছিল। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় তারা নববর্ষকে নতুন রূপে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নগরায়নের ফলে গ্রামীণ কর্মকাণ্ড অনেক কমে গেছে। শহর কেন্দ্রিক সভ্যতার প্রসার ঘটছে। আগে ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে থাকতেন। এখন সেটা কমে এসেছে ৩০ ভাগে। পহেলা বৈশাখ বা বিভিন্ন উৎসবে গ্রামে যে মেলা হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখন সেগুলো ওভাবে হচ্ছে না। এক সময় পহেলা বৈশাখে এক হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হতো গ্রামে। সেটা এখন তেমন আর নেই। পহেলা বৈশাখ এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আধুনিক নগর সভ্যতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই আমরা দেখছি। সরকারের উচিত হবে নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি শুধু শহরে হয় তাহলে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। কিন্তু গ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমবণ্টন হয়। এতে উপকৃত হন সবাই।
চিরায়ত রীতি অনুযায়ী, গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামা-কাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানারকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠা-পুলির আয়োজন, অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন, যেমন- নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি ইত্যাদি। বৈশাখীমেলা কেন্দ্রিক যে অর্থনেতিক কর্মকাণ্ড যা আগের মতো এতটা সচল না থাকলেও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, যদিও এলাকাভিত্তিক এর প্রধান্য রয়েছে অনেকাংশে। তবে অনেকেই তাদের মূল পেশা ধরে রাখতে পারছে না কেবল প্রণোদনার অভাবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু জিনিস হারিয়ে যাবে। তবে কিছু জিনিস আমাদের রক্ষাও করতে হবে। এটা শুধু আমাদের দেশে না, সারা বিশ্বেই এমন। আধুনিক সভ্যতার ফলে কিছু জিনিস হারিয়ে গেলেও বৈশাখী উৎসবটা আমাদের ধরে রাখতে হবে।
আদি পেশাজীবী যারা নববর্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসত এখন জেনারেশন গেপের কারণে তাতের পোষ্যরা আর এ কাজ করছে না বিধায় শিক্ষা নিয়ে তারা অন্য পেশায় চলে যায়, যেমন- কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে নেই, বাঁশিওয়ালার ছেলে আর বাঁশি বাজানোর পেশায় আসছে না, কুমারের ছেলে আর পৈতৃক পেশায় থাকতে চাচ্ছে না, যা সব পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোন কাজে আয় বেশি হবে, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করলে চাকরি পাওয়া যাবে, তা হয়ে গেছে বিবেচ্য বিষয়। যার ফলে বাংলা নববর্ষের কিংবা পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক উপাদানগুলো সংকটে পড়েছে বর্তমান সময়ে, যা চলমান রাখতে সরকারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারকদেরও ভূমিকা কম নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
এখন সংস্কৃতি বড় না জীবন বড় তা অবশ্য মূল্যায়নের সময় এসেছে এবং বেঁচে থাকতে হলে দুটিরই প্রয়োজন। তবে স্থান, কাল ভেদে তা জনগণ ও সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে।