#সিন্ডিকেটের অভিযোগ ক্রেতার
প্রায় মাসখানেক ধরে চলা অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য সয়াবিন তেলের সংকট আরো তীব্র হয়েছে। এতদিন খুচরা বাজারে পরিমাণে কম এবং ছোট বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও রোজার ঠিক আগে সেটিও উধাও হয়ে গেছে। পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে রান্নার অন্যতম উপকরণ সয়াবিন তেল। কালেভদ্রে বিভিন্ন দোকানে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ১-২ লিটার কিংবা ৫০০ মিলিলিটারের ছোট বোতল মিলছে। তবে প্রচলিত কোম্পানির ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল একেবারেই উধাও হয়ে গেছে।
রোজার অতিপ্রয়োজনীয় এ নিত্যপণ্যটির কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। ভোজ্যতেল মালিকরা বলেছিলেন, রমজান সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই। কিন্তু তাদের সে কথা আর কাজে কোন মিল নেই। কাল রবিবার থেকে থেকে রোজা শুরু হলেও বাজারে তেলের সঙ্কট কাটেনি।
রমজানে সবজি ও আমিষের সাথে ছোলা, তেল, চিনি ও খেজুরসহ আট থেকে ১০টি পণ্যের চাহিদা কয়েকগুণ বেশি। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিবছরই অস্বাভাবিক মুনাফা করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে এবার মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশকিছু পদক্ষেপে কয়েকটি পণ্যের দাম গেলবছরের তুলনায় ৫-১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
সাধারণ ক্রেতা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর পেছনে জড়িত সেই পুরনো সিন্ডিকেট। নিম্ন আয়ের মানুষের জনদুর্ভোগ কমাতে রমজানে অযৌক্তিক দাম বাড়ানো নজরদারি ও কঠিন শাস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরনো নিয়মেই তেল সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু উদ্যোগে রমজানের ১৫ দিনের কম সময়েও সেসব পণ্যের সরবরাহ ও দাম এখনো স্বাভাবিক আছে। আশা করা যাচ্ছে রমজানে চলাকালীন সময়ে একই রকম থাকবে।
শনিবার রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট কাঁচাবাজার, শান্তিনগর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ও পাড়া-মহল্লায় ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, রোজার মাসকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ নিত্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ছোলা, খেজুর, চিনি, মটর ডাল, সয়াবিন তেল ও ফলসহ বিভিন্ন পণ্য গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি আমদানি হয়েছে। আর গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে গত জানুয়ারিতে প্রায় চার গুণ বেশি সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে।
সরকারের গাফিলতিকেই দায়ী করেছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এস নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, আমাদের উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছিলেন যে এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সমাধান হয়নি। এখন পারস্পরিক দোষারোপ চলছে। এগুলো করেই সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করা হয়েছে। সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল, সেটি নিতে পারেনি। যা ভোক্তাদের জন্য বাড়তি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুই লাখ ৩২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল খালাস হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ৬৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে সয়াবিন বীজের আমদানিও বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে তিন লাখ টন সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে, গত এক বছরে রেকর্ড সর্বোচ্চ। প্রশ্ন উঠেছে, এত আদানির পরও সয়াবিন তেল গেল কোথায়? কেন দোকান ঘুরে সহজেই মিলছে না রান্নার এই জরুরি উপকরণ? ভোজ্যতেল মজুদ করে রাখা হয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর জন্য এ অপকর্ম করছে সেই পুরনো সিন্ডিকেট। এমন অভিযোগই করছেন সাধারণ ক্রেতারা।
মূলত প্রায় চার মাস ধরে চলছে বোতলজাত তেলের এই সংকট। নভেম্বরে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এরপর সরকার সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমায়। যাতে আগের চেয়ে প্রতি লিটারে ১১ টাকা কম খরচ হচ্ছে তেল আমদানিতে। এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বাধ্য হয়ে গত ৯ ডিসেম্বর তাদের সঙ্গে সভা করে প্রতি লিটারে আট টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দাম বাড়িয়ে নেয়ার পরেও আবারও জানুয়ারি থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। নড়ে-চড়ে বসার জন্য সরকারের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ভোজ্যতেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে। ওই সময় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তেলের কোনো সংকট নেই। বরং আগের চেয়ে সরবরাহ বেশি। এরপরও বাজারের চিত্র ভিন্ন হওয়ায় আবারো তেল সরবরাহকারীদের ডাকে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
সভায় টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম তখন বলেন, তেল সরবরাহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। কারণ সরকার এর আগে মূল্য কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, এজন্য কিছু কমানো হয়। শফিউল আতহার তসলিম বলেন, বিদেশ থেকে সয়াবিন আসতে ৫০-৬০ দিন ও পাম তেল ১০-১২ দিন সময় লাগে। বর্তমানে সবাই গতানুগতিক সরবরাহ করছে। এমনকি সরকারি দরের চেয়ে ১৫ টাকা কম দামে পাম তেল বিক্রি হচ্ছে। রোজার জন্য কোম্পানিগুলো দ্বিগুণ এলসি করেছে। সেপ্টেম্বরের এলসি অক্টোবরে করা হয়েছে। এসব পণ্য ডিসেম্বরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ব্রাজিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা দেরি হয়েছে। রোজার আগে সব তেল চলে আসবে।
এর মধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছিল, আসন্ন পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই। কিন্তু তাদের সে কথা আর কাজে কোন মিল নেই। আজ রবিবার থেকে থেকে রোজা শুরু হলেও বাজারে তেলের সঙ্কট কাটেনি।
রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুর এলাকার গৃহবধূ নাসিমা সুলতানা বলেন, মুদি দোকানে গিয়ে সয়াবিন তেল খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। আবার পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। একই রকম অভিযোগ রাজধানীর মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা জব্বার আলীর। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জব্বার বলেন, একেক সময় একেক পণ্য মজুদ করে বাজার সিন্ডিকেট ক্রেতাদের জিম্মি করে রাখে। এবার রোজার আগেই তারা সয়াবিন তেল দিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করেছে।
শহীদুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, রোজায় ভাজাপোড়া খাবার তৈরিসহ বিভিন্ন কারণে সয়াবিন তেলের প্রয়োজনীয়তা বেশি হয়। কিন্তু দোকান ঘুরেও বোতলজাত তেল পাইনি। শেষ পর্যন্ত কয়েক দোকান ঘুরে ২ লিটারের ১টি বোতল পেয়েছি। সায়মা নাহার নামে আরেক ক্রেতা বলেন, সয়াবিন তেলের এই সংকট গত মাসেই শুরু হয়েছে। এটি এখনো সমাধান হয়নি। কিন্তু দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি, যাতে রমজান মাসে ভোক্তারা স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
ভোজ্য তেল নিয়ে এমন ভোগান্তির মধ্যে নড়ে বসেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান ভোজ্য তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য নিতে বাধ্য করলেই কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে সয়াবিন তেলের বোতল দৃশ্যমান নেই। বোতলজাত তেল চাইলে তারা ক্রেতাদের না করে দিচ্ছেন। তবে খোলা তেল ও পাম অয়েলের পর্যাপ্ত মজুদ দোকানগুলোতে দেখা গেছে। আবার অনেক দোকানে প্রচলিত সয়াবিন তেলের কোম্পানির অনুপস্থিতিতে স্থানীয়ভাবে বোতলজাত করা বিভিন্ন নামের বোতলজাত সয়াবিন তেল দেখা গেছে। তবে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকটের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ দোকানি। তারা বলেন, এমন কি হয়ে গেল যে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই চলমান সংকট সমাধান করা গেল না। এছাড়া ডিস্ট্রিবিউটর পর্যায়েও তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে আমরা খুচরা বিক্রেতারা পর্যাপ্ত পণ্য পাচ্ছি না।
সম্প্রতি ভোক্তা অধিকারের এক বৈঠকে ভোজ্যতেলের অন্যতম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শফিউল আতাহার তাসলিম দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং জাহাজ ভিরতে অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে।
গত বছর জানুয়ারিতে রোজায় বহুলব্যবহৃত আট ধরনের পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাখা হয় ৯০ দিন বাকি রেখে পণ্য আমদানির সুযোগ। কিন্তু এরপরও সেসময় কয়েকটি পণ্যে অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। তবে এবছর ইতোমধ্যে সেসব পণ্য আমদানিতে বেশকিছু শর্ত শিথিল করে প্রণোদনা দিয়ে কয়েকটি নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ডলারের দাম বাড়লেও এসব পণ্যের কয়েকটির দাম গত বছর থেকে কম আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। সেই সাথে তেল ও চিনির সংকট থাকবে না বলে জানান তারা। কিন্তু দাম বাড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কিছু জানাতে পারছেন না বাজারজাতকারীরারা।
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, সবসময় যেটা চেষ্টা করা হয় সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে। এবারো হয়ত সরকারের তরফ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে যে আমদানি বা সরবরাহে কোনো বিঘ্ন নাই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুষ্ঠু ডিস্ট্রিবিউশন। পণ্য সামগ্রী ঠিক থাকলো কিন্তু দাম নাগালের বাইরে থাকলো। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পণ্য সরবরাহ করা না গেলে জনদুর্ভোগ কমবে না।