সিসাদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। বর্তমানে দেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। শিশুদের রক্তে সিসার এই উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে সিসামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কৌশল প্রণয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিআইসিসিতে ‘আন্তর্জাতিক সিসাদূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ’ উপলক্ষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ইউনিসেফ আয়োজিত জাতীয় কর্মশালায় এই আহ্বান জানানো হয়।
কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সিসা ও ভারী ধাতুর দূষণ একটি নীরব ঘাতক, যা মোকাবেলায় প্রয়োজন জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। সবার জন্য একটি সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ ও ২০৪০ সালের মধ্যে সিসাদূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে আসার প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করতে একটি বিস্তৃত ও কার্যকরী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ারস বলেন, ‘সাধারণত, ভারী ধাতু বিশেষ করে সিসা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে, এই ক্ষতি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সীমা কমে যায় এবং প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ দেখা দেয়, আর গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে তাদের অনাগত শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সুস্পষ্ট আইন ও বেসরকারি খাতের সঠিক পদক্ষেপ দ্বারা এই দূষণ প্রতিরোধযোগ্য।
দূষণের শিকার ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের যে অতিরিক্ত খরচ ও ভোগান্তি হয়ে থাকে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বাড়তি খরচ হয়, সেটাও অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব। আশা করি, সরকার ও অংশীদারদের সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ প্রতিটি শিশুর সিসা ও বিষাক্ত ধাতুমুক্ত পরিবেশে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে।’
সিসাসহ শিশুদের ক্ষতিসাধন করে এমন ভারী ধাতুর উৎস সম্পর্কে ধারণা বাড়ানো এবং সিসার দূষণ কমানোর লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কর্মশালায় পূর্ববর্তী গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়, যেখানে শিশুদের রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি, সিসার উৎস ও দূষণের উপায়গুলো দেখানো হয়। বলা হয়, সিসা দূষণের বাস্তবতা বুঝতে হলে সারাদেশে এর উপস্থিতি (রক্তে সিসার মাত্রা) সম্পর্কিত উপাত্ত জানা জরুরি।
এসব বিষয় জানা থাকলে বাংলাদেশ সরকার, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর একসঙ্গে সিসা দূষণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে।
কর্মশালায় জানানো হয়, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী ও সিলেট জেলায় ৯৮০ জন এবং ঢাকায় ৫০০ শিশুকে পরীক্ষা করে সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি পেয়েছে। এসব নমুনার মধ্যে চার জেলায় ৪০ শতাংশ এবং ঢাকায় ৮০ শতাংশ নমুনায় প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা পাওয়া যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রার চেয়ে বেশি। অবশ্য শিশুদের রক্তে কোনো মাত্রায় সিসার উপস্থিতিই নিরাপদ নয়। তাই এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সিসা শনাক্তকরণ ও সিসা প্রতিরোধ করতে হবে।
কর্মশালায় বলা হয়, সিসা দূষণ একটি জরুরি পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংকট, বিশেষ করে বাংলাদেশে। দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন পরিবেশে ভারী ধাতুর দূষণ বাড়িয়েছে, ফলে শিশুদের বাতাস, পানি, মাটি, খাবার, খেলনা, রং ও রান্নার সামগ্রীর মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটির নারী ও শিশুদের মধ্যে সিসা দূষণের প্রভাব ব্যাপক; এটি ছোট শিশুদের জন্য বেশি ক্ষতিকর, যা স্থায়ীভাবে তাদের স্নায়বিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণ হচ্ছে।